শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঐতিহ্য বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের চমচম

জিন্নাতুন নূর, টাঙ্গাইল-বগুড়া থেকে ফিরে

ঐতিহ্য বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের চমচম

বড় একটি কড়াইয়ে ফুটন্ত রসের সিরায় ভাজা হচ্ছিল ছানার তৈরি মিষ্টি। সেই মিষ্টির সুবাসে মৌ মৌ করছিল চারদিক। এক কারিগর মনোযোগ সহকারে মিষ্টিগুলো ভাজছিলেন। তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন টাঙ্গাইলের বিখ্যাত কালীদাস মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক সমর সাহা। তিনি হাতে একটু সিরা তুলে তা মুখে দিয়ে মিষ্টির স্বাদ ঠিক আছে কিনা পরখ করলেন। তারপর মাথা নেড়ে তার মিষ্টির কারিগরকে ‘হ্যাঁ’ সূচক সায় জানালেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে         সমর বললেন, ‘বৈশাখ দোরগোড়ায়। আমাদের এখন দম ফেলার ফুরসত নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিষ্টি তৈরি করছি। তা চোখের পলকে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মিষ্টিই ঢাকায় চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ঢাকা যাওয়ার পথে বা ঢাকা থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথেও মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বৈশাখের এই সময় এবং দুই ঈদ ও পূজায় এ মিষ্টির বিক্রি বৃদ্ধি পায়।’ টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের নাম শুনলেই ছোট-বড় সবার জিভে পানি আসে। রসে টইটম্বুর লাল রঙের এই মিষ্টি অপছন্দ করেন— এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। আরও কথা হয় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের জামুকি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন কালীদাস মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক সমর সাহার সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের বংশের তিন প্রজন্ম মিষ্টির ব্যবসা করছে। তার অন্য দুই ভাই ভিন্ন পেশায় থাকলেও বাপ-দাদার পেশা তিনি ভালোবেসেই ধরে রেখেছেন। নিজের ছেলে নেই, কন্যা আছে। তারা বাবার পেশায় আগ্রহী নয়। এজন্য যতদিন বেঁচে থাকবেন মিষ্টি বানিয়ে যাবেন বলে তিনি জানান।

সমর সাহার এই কথার সত্যতা মিলল একটু পরেই। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন মিষ্টান্ন দোকানের সামনে লম্বা প্রাইভেট কারের সারি দেখে বোঝা গেল, বৈশাখে মিষ্টির বেচাবিক্রি তুলনামূলক বেশি। টাঙ্গাইল মহাসড়কের ওপর দিয়ে যাতায়াতকারী ঢাকামুখী বিভিন্ন প্রাইভেট কারের লম্বা সারি এসব দোকানের সামনে। কালীদাস মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে পাঁচ মিনিট দাঁড়াতেই দেখা গেল চার-পাঁচজন ক্রেতা ১০ হাজার টাকার ওপর মিষ্টি কিনেছেন। তাদের মধ্যে একটি বেসরকারি এনজিওর কর্মকর্তা শাহীন ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অফিসের কাজে বগুড়া গিয়েছিলাম। বাসায় ফেরার পথে স্ত্রী-কন্যা জানাল, টাঙ্গাইলের চমচম যেন অবশ্যই কিনে নিয়ে যাই। বৈশাখে মিষ্টি যেহেতু কিনতেই হবে— এজন্য ভালো মিষ্টিটাই কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’ চমচমের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের বগুড়া বিখ্যাত দইয়ের জন্য। এই অঞ্চলের দইয়ের খ্যাতি শুধু উত্তরাঞ্চলেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে এবং অতিথি আপ্যায়নে ঘরে ঘরে খাবার তালিকায় আর কিছু থাকুক বা না থাকুক— মিষ্টি দই অবশ্যই থাকা চাই। এমনকি নববর্ষে কারও বাড়িতে বেড়াতে গিয়েও মানুষ এক হাঁড়ি দই নিয়ে যাওয়াকে বাংলার সংস্কৃৃতির এক ধরনের অংশ বলে মনে করেন।

সম্প্রতি দইয়ের রাজধানী বগুড়ায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দইয়ের কারিগররা দই তৈরি করছেন, আবার তা দোকানে নিয়ে রাখতেই নিমিষে ফুরিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতার চাহিদা মেটাতে বিক্রেতারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। বগুড়ার কবি নজরুল ইসলাম সড়কের বিখ্যাত এশিয়া সুইটমিটে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় লেগে থাকে। বৈশাখকে সামনে রেখে ক্রেতারা তাদের চাহিদামতো দইয়ের হাঁড়ি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা থেকে যারা কাজে এই অঞ্চলে এসেছেন, তারাও ফিরতি পথে বগুড়ার দই কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢাকা থেকে আসা এক ব্যবসায়ী রাসেল আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসার কাজে বগুড়ায় এসেছিলাম। ফেরার পথে বগুড়ার দই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে দই কেনা যায়, তবে স্বাদে তা এই দইয়ের কাছেও ঠেকবে না।’ এই দোকানের এক কর্মচারী জানান, বিগত ৩৫ বছর ধরে বগুড়ায় তারা সুনামের সঙ্গে দই বিক্রি করে যাচ্ছেন। সুনাম থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে দই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও বৈশাখের আগে আগে এই সড়কে দইয়ের জন্য আরও বেশ কয়েকটি দোকানেও ক্রেতার ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।

সর্বশেষ খবর