মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ট্রেন কেন বারবার দুর্ঘটনায়

তদন্ত কমিটি হয় সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না

সাঈদুর রহমান রিমন

ট্রেন কেন বারবার দুর্ঘটনায়

রেল সংশ্লিষ্টদের অবহেলা আর যাত্রীদের অসচেতনতায় ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি হয়, দফায় দফায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সাক্ষ্য গ্রহণ চলে— তদন্ত প্রতিবেদনও দাখিল হয়। দোষী রেল কর্মীদের হালকা শাস্তি প্রদানের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সবকিছু। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনের দেওয়া সুপারিশের আলোকে কোনো কিছুই করা হয় না, সমাধান হয় না ত্রুটি-বিচ্যুতির। ফলে ট্রেন দুর্ঘটনা বেড়েই চলে জ্যামিতিক হারে।

প্রতিটি রেল দুর্ঘটনার পর পরই তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের সাময়িক বরখাস্ত কিংবা তিরস্কারের মধ্যেই শাস্তি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন রেল সংশ্লিষ্টদের অবহেলা বাড়তে থাকে, অন্যদিকে ঘটতে থাকে রেল দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

অপরদিকে ট্রেন চালকসহ পরিবহন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তাদের প্রতিবেদনে শুধু ট্রেনচালক, স্টেশন মাস্টার ও পরিবহন কাজ-সংশ্লিষ্টদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। লুপ, শাখা ও মেইন লাইনের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও দায় চাপানো হয় পরিবহন বিভাগের ওপর। লাইনের ত্রুটির জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল দফতরের বিরুদ্ধে। এভাবেই পরিবহন ও প্রকৌশল বিভাগের একে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর প্রতিযোগিতায় আড়াল হয়ে পড়ে প্রকৃত ঘটনা। ফলে একই লাইনে বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও পরবর্তীতে তা এড়ানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।  ২০ বছরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ৫৭০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার অধিকাংশই পতিত হয়েছে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে। এ ছাড়া যথাযথ সিগন্যালের অভাব, লাইনের ত্রুটি ও যাত্রী অসাবধানতার কারণেও ব্যাপক সংখ্যক রেল দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, টঙ্গী থেকে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার রেললাইন যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ লাইনে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রায়ই মিলছে লাশ। মগবাজার, বনানী, কুড়িল রেলক্রসিং পারাপারকালে অসতর্ক পথচারী মারা যাওয়ার সর্বাধিক ঘটনা ঘটে বলেও রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে। অথচ সেসব ক্রসিং পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা গেটম্যানদের বিশেষ নজরদারি রাখার নির্দেশনা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। রেলওয়ে পুলিশ জানায়, অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র অনুমোদন ছাড়াই রেল লাইনের ওপর দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কারণে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ সত্তেও নাগরিকদের রেললাইনের ওপর দিয়ে বেপরোয়া চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিন বছরে প্রায় এক হাজার রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশই লেভেল ক্রসিংজনিত দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৪ টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। অপমৃত্যু মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি। ২০১৬ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। চলতি এপ্রিলের পূর্ববর্তী ১৫ মাসে মারা গেছেন ২৭৮ জন। শুধু গেন্ডারিয়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকায় রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৯৩ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী। গত বছর ১১ আগস্ট শায়েস্তাগঞ্জ-রশিদপুর সেকশনে বি-স্পেশাল-২ নামের ট্রেনটি পয়েন্ট নং-২৯ (এ) অতিক্রমকালে বিএফআর নং-৩৫৫৩০-এর সামনের ট্রলির বাম ও ডান পাশের চাকা লাইনচ্যুত হয়। মূলত লাইন সম্প্রসারণের ফলে ট্রেনটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে বলে রেলের প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে। ২০ আগস্ট দুর্ঘটনায় পড়ে আখাউড়া সেকশনের ৯৫১ নম্বর ট্রেন। দীর্ঘদিন ধরে ট্র্যাক সার্কিট (নং ডব্লিউ-১০৪) মেরামত না করায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ পায় রেলের পরিবহন বিভাগ। ওই সময় ৫ নম্বর লাইনে সম্পূর্ণ ট্রেন প্রবেশের বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই পয়েন্ট পরিবর্তন করায় দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ ছাড়া ১১ আগস্ট নাথেরপেটুয়া-সোনাইমুড়ি সেকশনে একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে ৮৮ নম্বর ডেমু ট্রেনের। মূলত অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পরিবহন বিভাগ। সর্বশেষ গতকাল টঙ্গী স্টেশনের কাছে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় আতঙ্কিত লোকজনের লাফালাফিতে অন্তত চারজন নিহত ও বিশজনেরও বেশি আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ট্রেনটির পেছনের চারটি বগি লাইনচ্যুত হলেও গতির কারণে ওই অবস্থায় ট্রেনটি কয়েকশ গজ এগিয়ে যায়।

একপর্যায়ে দুটি বগি কাত হয়ে যায়। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি মো. ইয়াসিন জানান, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পর ছাদে থাকা যাত্রীরা লাফিয়ে পড়লে ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয় এবং আরও বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন।

দুর্ঘটনার ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (অপারেশন) হাবিবুর রহমান বলেন, ‘রেল এখনো নিরাপদ বাহন হিসেবে জনপ্রিয়। বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শেষ হলেও ইঞ্জিন-কোচ সংকটের পাশাপাশি লুপ ও শাখা লাইনগুলোর নাজুক অবস্থার কারণে প্রকৃত সেবা দিতে পারছে না রেলওয়ে। বর্তমানে পুরনো লাইনগুলো পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রেলওয়ের সেবার মান আরও বাড়বে।’ রেলওয়ে সূত্রমতে, সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের দুটি ডাবল লাইন প্রকল্প সমাপ্ত করেছে রেলওয়ে। শুরু হয়েছে লাকসাম-আখাউড়া পর্যন্ত ডাবল লাইনের কাজ।

প্রায় ২৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম স্টেশনের রি-মডেলিং প্রকল্প ছাড়াও ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী ও নাজিরহাট রুটের রেলপথও সংস্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ১৮০ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ ২০১৩ সালের নভেম্বরে শুরু করে তা ১৫ মাসে শেষ করা গেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনাবিদ আনোয়ারুল হক বলেন, ট্রেন আসার আগে দেড় কিলোমিটার পথ বাকি থাকতেই বাজবে সতর্কতামূলক অটো বেল। কাছে আসার পর বাজবে জরুরি ঘণ্টা। লাল ও নীল বাতির মাধ্যমে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে থাকবে বাড়তি জনবল। অবৈধ বাজার ও স্থাপনাসহ দখল রোধে লাইনের দুই পাশে নির্মাণ করা হবে দেয়াল। করা হবে লাইনের মানোন্নয়ন। পাঁচ ধরনের লেবেল ক্রসিংগুলোকে আপগ্রেড করা হচ্ছে। ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত সময়ের মধ্যে নেওয়া হচ্ছে এসব ব্যবস্থা। ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আনোয়ারুল হক আরও বলেন, রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং উন্নয়নের জন্য এ মুহূর্তে দুটি প্রজেক্টের কাজ চলছে। ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্ব) লেভেল ক্রসিং গেট আধুনিকায়ন’ ও ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে (পশ্চিম) লেভেল ক্রসিং গেট আধুনিকায়ন’ নামে দুই বছর মেয়াদের প্রজেক্ট দুটি চলবে। এদিকে, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনগুলো বারবার লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর