শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বেপরোয়া পরিবহনের মালিক কারা

সরকারি দলের প্রভাবশালী এমপি, শ্রমিক নেতা, যুবনেতা, পুলিশ কর্মকর্তারা নামে-বেনামে পরিবহনের মালিক

সাঈদুর রহমান রিমন

বেপরোয়া পরিবহনের মালিক কারা

বিপজ্জনকভাবে দুই বাস পাশাপাশি। তোলা হচ্ছে যাত্রী।

রাজধানীর পরিবহন কোম্পানির বাস-মিনিবাস দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এসব গাড়ির চালক-শ্রমিকদের কাছে অন্য গাড়ি, যাত্রী, পথচারী সবার জীবনই বিপন্ন। মালিকদের ক্ষমতার দাপটে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়েও চালক-শ্রমিকরা পার পেয়ে যান। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এসব কোম্পানির গাড়ির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন।

রাজধানীতে বাসচালকরা মালিকদের ভাড়ার টাকা শোধ করার পর বাড়তি মুনাফা করায়ত্ত করতে তারা নিজের গাড়িকে অন্যের গাড়ির সামনে নিয়ে যাওয়ার মতলবে এক অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। তখন তারা আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেন না। রাস্তায় প্রতিযোগী দুই বাসের চাপায় পড়ে হাত হারিয়ে পরে জীবনও হারিয়েছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। এর তিন দিন যেতে না যেতেই শুক্রবার বাসচাপায় মেরুদণ্ড ভেঙেছেন গৃহিণী আয়েশা খাতুন। এভাবে শুধু রাজীব বা আয়েশা খাতুন নন, রাজধানীতে প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ হাত-পা হারিয়ে বরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন পঙ্গুত্বের দুর্বিষহ জীবন। অনেককেই হারাতে হচ্ছে জীবনটিও। বিআরটিএ ও পরিবহন মালিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। হিউম্যান হলার, অটোরিকশা ও অনেক বাস-মিনিবাসের মালিক পুলিশ কর্মকর্তা। মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কে চলাচল করছে প্রভাতী, আজমেরী, সুপ্রভাত স্পেশাল ও গাজীপুর পরিবহন। গুলিস্তান-ধামরাই রুটের বাস দিশারী, গাবতলী মিনিবাস মালিক সমিতি, নিউ ভিশন, ভুঁইয়া, মৌমিতা, তেঁতুলিয়া, ঠিকানা, সাভার, নূরজাহান মানিকগঞ্জ, ফুলবাড়িয়া, প্রজাপতি, লাব্বাইক, আশীর্বাদ, প্রজাপতি, হিমাচল ও বসুমতী পরিবহনের বাসগুলোও যাত্রী হয়রানির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর কনক পরিবহন মিরপুর থেকে আগারগাঁও, মহাখালী, কাকলী হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত রুটে ১৫টি বাস নামানোর অনুমতি পায়। জাবালে নূর পরিবহনের উদ্যোক্তা অরাজনৈতিক হলেও এর পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মিরপুর যুবলীগের এক নেতা। প্রজাপতি পরিবহনের মালিক আওয়ামী লীগের মিরপুরের এক সাবেক এমপি। বসুমতী পরিবহন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর। আজিমপুর থেকে উত্তরা পথে চলাচলকারী ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে রয়েছে সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বাস। একজন প্রভাবশালী এমপির চাচাতো ভাইয়ের বাসও চলে ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে।

রাজধানীতে গাড়িচাপায় সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে তেঁতুলিয়া পরিবহন। মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর হয়ে আবদুল্লাহপুর রুটে পরিচালিত এই পরিবহনে অনুমোদিত গাড়ি আছে মাত্র ৫০টি। অথচ একই সাইনবোর্ডে ১৩০টিরও বেশি গাড়ি চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তেঁতুলিয়া পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান ভোলার এক এমপি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম মিয়া। জানা যায়, মাত্র আড়াই বছরে তেঁতুলিয়া গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ও বেপরোয়া চালানোজনিত দুর্ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে।

রাজধানীতে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি সবচেয়ে বেশি চলাচল করে বিহঙ্গ পরিবহন নামের একটি কোম্পানির। আজিমপুর, মিরপুর-১২, কুড়িল ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী এ পরিবহনের গাড়ির সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। বিহঙ্গ পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতা এবং এমডি পরিবহন মালিক খোকন মিয়া।

সম্প্রতি এক জরিপে সড়ক-মহাসড়কের মৃত্যুদানব বলে যে ১০টি পরিবহনের বেপরোয়া চলাচলের কথা তুলে আনা হয়েছিল সেসব পরিবহনের মালিকরাও একেকজন গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত। এসব পরিবহন হচ্ছে এনা, আজমেরী, এশিয়া, বিহঙ্গ, পদ্মা লাইন, পারিজাত, তুরাগ, তিশা, সি লাইন, ইলিশা, প্রাইম ও হানিফ পরিবহন। অনাবিল সুপার গাড়ির ভাঙাচোরা অবস্থার যানবাহন চলে সাইনবোর্ড থেকে উত্তরার পথে। অনাবিল সুপার কোম্পানির চেয়ারম্যান সোলেমান মিয়া এবং এমডি ক্ষমতাসীন দলের নেতা জুয়েল দেওয়ান। অনেক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাও কয়েকটি পরিবহনের মালিক।

বর্তমানে ঢাকা ও আশপাশের রুটগুলোয় এক বা একাধিক মালিকের সমন্বয়ে গঠিত কোম্পানির আওতায় বাস ও মিনিবাস চলাচল করছে। এবার প্রত্যেক রুটেই একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছেন প্রভাবশালীরা। এরই অংশ হিসেবে ‘এক রুটে এক কোম্পানি’ নীতিতে গাড়ি চালানোর কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা ও আশপাশ এলাকা সাত-আটটি রুটে ভাগ করা হবে। প্রতিটি রুটেই একক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বর্তমানে মতিঝিল, গুলিস্তান থেকে মোহাম্মদপুর রুটে নয়টি বাস কোম্পানির গাড়ি চলাচল করছে। গুলিস্তান থেকে মিরপুর রুটে ২০টির বেশি বাস কোম্পানির গাড়ি রয়েছে। বর্তমানে ঢাকায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার গাড়ি চলাচল করে। মোহাম্মদপুর থেকে সায়েদাবাদ চলাচলকারী আয়াত, হিমাচল, নবকলি, মেশকাত ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ও এভারেস্ট পরিবহন লিমিটেডেরও বেপরোয়া চলাচল ও অনেক দুর্ঘটনা ঘটানোর নজির রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী এটিসিএল, এফটিসিএল, মিডওয়ে, বাহন, ৮ নম্বর (গাবতলী-যাত্রাবাড়ী), ৩ নম্বর (সুপ্রভাত) ও তুরাগ পরিবহনের যাত্রীরা বলেন, এই পরিবহন কোম্পানির বাসগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে ‘রেসিংয়ে’ মেতে ওঠে রাস্তায়। সিরিয়ালের গাড়ি হলেও একটি অন্যটিকে পেছনে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সামনের বাস না সরলে পেছনের বাসটা সজোরে ধাক্কাও মারছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ট্রাফিক) এক কর্মকর্তা বলেন, পদে পদে বাধা-প্রতিকূলতা থাকলেও পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করে না। কিন্তু অধিকাংশ ফিটনেসবিহীন গাড়ি প্রভাবশালী রাজনীতিক কিংবা শ্রমিকনেতার। যাদের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। পাল্টা অভিযোগও রয়েছে। বলা হয়, পুলিশ ইচ্ছা করেই এসব অজুহাত দাঁড় করায়। কারণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি পুলিশের ঘুষ-বাণিজ্যের অন্যতম ‘কাঁচামাল’। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে নয়, ব্যবসায়ীদের হাতেই পরিবহন ব্যবসা আছে। তিনি বলেন, পরিবহন খাতে প্রতিনিয়ত আইনের প্রয়োগ আছে এবং সর্বোচ্চ মাত্রার প্রয়োগই হচ্ছে। বরং আইনি জাঁতাকলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। সেখানে বেপরোয়া চলাচলের প্রশ্নই ওঠে না। খন্দকার এনায়েত বলেন, ইদানীং বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতায়, অসচেতনতায়।

সর্বশেষ খবর