শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নবাবি আমলের পুকুরে গ্রামীণ আবহ

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-২২

মাহবুব মমতাজী

নবাবি আমলের পুকুরে গ্রামীণ আবহ

স্বচ্ছ পানির জলাধার হিসেবে রাজধানীতে এক সময় অসংখ্য পুকুর থাকলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর পুকুর। গ্রামীণ আবহের এ দৃশ্য এখন ধরে রেখেছে শুধু পুরান ঢাকার বংশাল ও ইসলামপুরের নবাবী আমলের দুটি পুকুর। প্রতিদিন ৫ টাকার বিনিময়ে এখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গোসল করতে নামে। তবে বংশালের পুকুরটিতে আপাতত পানি সংকটের কারণে গোসল বন্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত কমিটি। এ পুকুরে মাছ চাষ, গোসল, সাঁতার কাটা প্রায় দেড় শতাধিক বছর ধরে চলে আসছিল। ইসলামপুরের নবাববাড়ি পুকুরটির আকার বৃত্তের মতো গোল। তাই একে বলা হয় গোলতালাব পুকুর। কোথাও কোনো নোংরা আবর্জনা নেই, পরিষ্কার টলটলে পানি। আর সেই পানির নিচে মাছের ছোটাছুটি। দেখতেও অন্যরকম। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বংশাল পুকুরটিরও সৌন্দর্য আকর্ষণীয়। সাজ-গোছ প্রায় একই ধাঁচের। নয়াবাজার এলাকা থেকে নবাব ইউসুফ রোডে ঢুকে হাতের ডানে এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত এই পুকুর। এক সময় ঢাকায় দুই হাজার পুকুর ছিল। এখন দু-একটি খুঁজে পাওয়াও দুরূহ হয়ে পড়েছে। এক সময় পুকুর-খাল-ঝিলে ভরা ছিল মোগল আমলের এই ঢাকা। কালের বিবর্তনে আর মানুষের চাহিদায় ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে অসংখ্য পুকুর, খাল ও ঝিল।

জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজার। ১৯৮৯ সালের দিকে সেটা কমে দাঁড়িয়েছিল এক হাজার দুইশতে। সর্বশেষ ২০০৭ সালে তাদের আরেক জরিপে দেখা গেছে— সেই পুকুরের সংখ্যা এখন সাকুল্যে দুইশতে নেমে এসেছে। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও কমে গেছে। পুকুরের এই আকালের নগরীতে মাটি ভরাট করে ইট-পাথরের ইমারত গড়তেই আগ্রহী সবাই। এর মধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রম পুরান ঢাকা। সাড়ে ৬ বিঘা আয়তনের নবাববাড়ির গোলতালাব পুকুরের চারপাশ পিচ-পাথরের বাঁধানো পাকা রাস্তা আর নারিকেল গাছে ঘেরা। অন্তত ৫০টি নারিকেল গাছ এতে রয়েছে প্রায় একই উচ্চতার।

একের পর এক জলাশয় ভরাট করে গড়ে ওঠা কংক্রিটের রাজধানীতে এমন দৃশ্য বিরল। উনিশ শতকে খনন করা এই পুকুরটি আজও টিকে আছে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে।

আনুমানিক ১৬১০ সালে মোগল শাসকদের প্রতিনিধি ইসলাম খাঁ সুবেদার হিসেবে ঢাকায় আসেন। আর তিনিই প্রথমে বর্তমান ইসলামপুর এলাকায় আসেন। ফলে তার নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় ইসলামপুর। তারই আগ্রহে খোঁড়া হয়েছিল এই পুকুর। পরবর্তীতে ১৮৩০ সালে নবাব খাজা আলীম উল্লাহ কুঠিসহ এটি কিনে নেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পুকুরটির বৈধ মালিকানা পান। বর্তমানে সেখানে শান বাঁধানো ঘাট ও পাকা ছাউনিতে প্রতিদিন লোকজনের গোসলের সুব্যবস্থা আছে।

গোলাতালাব পুকুরের পর ব্রিটিশ আমলে বংশাল ও তার আশপাশে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দা এবং পুরান ঢাকার ‘সাত পরিবার’ নামে পরিচিত এর সদস্যরা পানির সমস্যা সমাধানে বংশাল পুকুর খননের উদ্যোগ নেন।

১৮৫২ সালে সাত পরিবারের সদস্যের পাঁচ ভাই হাজী বদরুদ্দিন, মাওলা বখশ, সাত্তার, সিদ্দিক ও ইমামউদ্দিন মিলে পুকুরটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় চার বিঘা আয়তনের নিজস্ব জমিতে পুকুরটি আজও এলাকার পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে। পুকুরের শান বাঁধানো দুটি ঘাটেই তৈরি করা হয়েছে উঁচু লোহার গেট। সেখানে গোসলের জন্য মাথাপিছু নেওয়া হয় ৫ টাকা করে। তবে পুকুরের উত্তর পাশের ঘাটটি শুধু মহল্লাবাসীর জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত।

বহু বছর ধরে পানি পরিবর্তন করা হয়নি বংশাল পুকুরে। সম্প্রতি এতে প্রচুর কাঁদামাটি জমে যায়। মাঝে দক্ষিণ-পূর্ব পাশের দেয়াল ধসে পড়ে। চার মাস আগে পুকুরটি সেচে পুনঃখনন ও সংস্কারকাজ শুরু করে বংশাল পঞ্চায়েতের অধীন বংশাল পুকুর পরিচালনা কমিটি। সংস্কারকাজও শেষ হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা বৃষ্টির। যত বেশি বৃষ্টি হবে, তত তাড়াতাড়ি পুকুর তার পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে পাবে।

গত বৃহস্পতিবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বংশালের হাজী আবদুল্লাহ সরকার লেনের (কাঠপট্টি) নারকেল ও মেহগনি গাছে ঘেরা বংশাল পুকুর। প্রায় ২০ ফুট গভীর পুকুরটির চার পাড়ে কংক্রিটের দেয়াল, এর ওপর তিন ফিট উঁচু গ্রিল। আর শুকনো পুকুরটিতে এখন শুধু হাঁটুপানি জমে আছে।

আতাউর রহমান নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি জানালেন, পুকুরটিতে প্রায় দুই যুগ ধরে সংস্কার কাজ হয়নি। পানিও তেমন পরিষ্কার করা হয়নি। তাই পুকুরটি সেচের পর পুনঃখনন ও সংস্কার করে ময়লা কাঁদামাটি সরিয়ে ফেলা হয়। এখানে স্থানীয় সবাই সকাল-দুপুর গোসল করতে আসে। বংশালের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ এই পুকুরে সাঁতার শিখেছে।

সর্বশেষ খবর