রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিষে ভরা মুড়ি

মির্জা মেহেদী তমাল

বিষে ভরা মুড়ি

খোলায় কয়েক মিনিট চাল গরম হওয়ার পর ছিটিয়ে দেওয়া হলো ইউরিয়া মিশ্রিত পানি। ১৫ মিনিট পর জ্বলন্ত চুলার খোলা থেকে চাল উঠিয়ে রাখা হয় ময়লা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে। মেঝেতে সোডিয়াম কার্বনেট ও সালফার মিশিয়ে চাল উত্তপ্ত বালুর চুঙায় ঢেলে দিলেই মুহূর্তে মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হয়ে যাচ্ছে ধবধবে সাদা মুড়ি। মজুদ হচ্ছে গুদামে। আর এই বিষাক্ত মুড়িই আসন্ন রমজানের ইফতারের প্রধান খাবার হিসেবে গ্রহণ করবে দেশের মানুষ। এ ছাড়া এসব মুড়ি সাধারণ মানুষ খাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

রমজানকে সামনে রেখে চাহিদা বাড়ে মুড়ির। তাই ব্যস্ততাও বেড়েছে মুড়ির কারখানাগুলোয়। রমজান এলে ইফতারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মুড়ি ব্যতিক্রমী স্বাদ বহন করে। সারা বছরই এ মুড়ির চাহিদা বাঙালির ঘরে ঘরে থাকে। রোজা এলে মুড়ির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। গ্রামগঞ্জে দেশীয় পদ্ধতি ছাড়াও বর্তমানে মিলে উৎপাদিত মুড়ি ব্যাপকভাবে বাজারজাত হচ্ছে। মিলে যে মুড়ি উৎপাদিত হচ্ছে তা কি আসলে মুড়ি নাকি স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি কোনো পণ্য? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় মুড়ি উৎপাদনের মিলগুলোতে গেলে। একসময় চালের সঙ্গে কাঁকর আর দুধের সঙ্গে পানি মেশানো ভেজালের কথা শোনা যেত। কিন্তু বর্তমানে মুড়িতে মেশানো হচ্ছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ধারা উৎপাদিত মুড়ি ব্যাপকভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে এমনকি প্যাকেটজাত করা হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে।

গাজীপুর কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তৈরি হচ্ছে এই বিষের মুড়ি। মানুষ নিজের অজান্তেই মুখে তুলে নিচ্ছে বিষ! গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মুড়ি তৈরির কারখানায় গিয়ে এমন ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। এসব কারখানায় তৈরি নরম ধবধবে সাদা মুড়ি হাতবদল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে। আর মুড়ি খেয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘেঁষে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় ডজনখানেক মুড়ি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। সারা বছর মুুড়ির চাহিদা থাকলেও পবিত্র রমজানে এ চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বিষাক্ত কেমিক্যালের পরিমাণও।

কুমিল্লার বিসিক শিল্প নগরীতে প্রায় ২০ থেকে ২৫টি মিলে মুড়ি উৎপাদন হয়ে থাকে। কিছু কিছু মিলে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মুড়ির দানা বড়, সাদা এবং সুস্বাদু করার জন্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক মুড়ির চালে মেশানো হচ্ছে। ক্ষতিকারক এসব কেমিক্যাল মিশিয়ে চাল রাখা হচ্ছে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে।

মুড়ি তৈরির কারখানার শ্রমিকরা জানান, রাত-দিন চুলা জ্বলন্ত থাকায় কারখানার কক্ষটিও উত্তপ্ত থাকে। ফলে শ্রমিকদের ঘামে কক্ষের পুরো মেঝে থাকে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। ময়লা-নোংরা খোলা মেঝে থেকেই প্যাকেটজাত মুড়ি গুদামজাত করা হয়। একটি কারখানার মালিক আবুল বলেন, তার কারখানায় তৈরি মুড়িতে কোনো বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কারখানার মুড়ি শ্রমিক জানান, ‘সব কারখানায় একইভাবে মুড়ি তৈরি হচ্ছে। সার মেশাইন্যা পানি ছিডাইয়া চাইল গরম কইরা খোলাততে নামানোর পরে কারিগররা চাইল একটু ঠাণ্ডা কইরা সোডার লগে আরও একটা পাউডার মিশাইয়া চাল চুঙায় ঢালে।’ তবে শ্রমিকরা মুড়ি উৎপাদনকালে চালে শুধু সোডা মেশানোর কথা স্বীকার করেছেন।

আরেক মুড়ি শ্রমিক বলেন, মুড়ির চালে কেমিক্যাল মেশানো হলে মুড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। এতে ক্রেতাদের কাছে চাহিদা বেড়ে যায়। আর এ জন্য আমরা কেমিক্যাল মিশ্রণ করে তা মুড়িতে মিশাই। জানা গেছে, মুড়িতে দুই দফা বিষাক্ত কেমিক্যালের মিশ্রণ ঘটে। ধান থেকে চাল তৈরির পর চালকল মালিকরা তাতে সালফার মিশিয়ে মুড়ি তৈরির চাল কারখানা মালিকদের কাছে বিক্রি করে।

দিনের পর দিন এ চাল কারখানার গুদামে পড়ে থাকে। কেমিক্যাল মিশ্রিত থাকায় মুড়ি উৎপাদনকালে চাল উপযোগী থাকে। ফের মুড়িকে আরও আকর্ষণীয় করতে কারখানা মালিকরা ইউরিয়া, সোডিয়াম কার্বনেট ও সালফার মেশান। মুড়ি তৈরির বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে অভিন্ন চিত্র।

গাজীপুরের সিভিল সার্জন সৈয়দ মো. মঞ্জুরুল হক বলেন, কেমিক্যাল মিশ্রিত মুড়ি খেলে তাত্ক্ষণিক বদহজম, বমি বমি ভাব ও মাথাধরাসহ শারীরিক সমস্যা হতে পারে। ইউরিয়াতো আমাদের খাবারের কোনো উপাদান নয়। এটি খাবারের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে স্টমাকের ক্ষতি করে। শুধু তাই নয়, এটি রক্তে মিশে গিয়ে কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর