সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফরাশগঞ্জের মাল্টি কোর্টইয়ার্ড বাড়ি

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-২৫

মাহবুব মমতাজী

ফরাশগঞ্জের মাল্টি কোর্টইয়ার্ড বাড়ি

বাড়ির ভিতরটা এখনো বেশ অসার। দরজা, জানালা ও সিঁড়িতে সেই আভিজাত্যের ছাপ। ভেঙে গেছে দেয়াল ও ছাদের বিভিন্ন অংশ। তবু এটি ঐতিহ্যের রূপ বহন করে। বাড়িটি যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়ের এক বাস্তবতা। তার সৌন্দর্যের অনুভূতি এখনো নাড়া দেয়। বলছি ফরাশগঞ্জের ‘বড়বাড়ি’র কথা। এটি এ নামেই পরিচিত। এখন সে অনেকটা শ্রীহীন। কিন্তু এককালে যে বিশেষ কিছু ছিল, তার চিহ্ন আজও বর্তমান। ফরাসিদের বসতির কারণে ফরাশগঞ্জের সুখ্যাতি পুরনো। এ অঞ্চলে ইংরেজ আধিপত্য কায়েমের আগে থেকেই তাদের বসবাস শুরু হয়। ফরাসিরাই এখানে মসলার ব্যবসা শুরু করেছিল। এখনো ফরাশগঞ্জে সেই মসলার কারবার আছে। বুধবার দুপুরে পুরান ঢাকার ওই এলাকার বি কে দাস রোডে ঢুকলে স্বাগত জানায় মরিচ-হলুদের ঝাঁঝাল ঘ্রাণ। এককালের সমৃদ্ধ আবাসিক এলাকা এখন ক্ষয়িষ্ণু। পাশেই স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা। বি কে দাশ রোডের ৪৪ নম্বর বাড়িটিই বড়বাড়ি। নব্য ধ্রুপদী নকশার এ বাড়ি প্রসন্ন কুমার দাশ তৈরি করেছিলেন ১৯০৫ সালের দিকে। এ বাড়ির নকশার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফরাসি রোকোকো, মাল্টি কোর্টইয়ার্ড অর্থাৎ একাধিক উঠান, এলিভেটেড ওয়াকওয়ে। বাড়ির মোট ভবন দুটি। তিনটি বারান্দা। কক্ষ ১০টি। সামনের অংশটুকু দ্বিতল, আবার পেছনটা তিনতলা। শোনা যায়, উঠানগুলোর কোনোটি ছিল পরিবারের সদস্যদের জন্য, কোনোটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়কদের জন্য। পুরো বাড়িতে থাকতেন বি কে দাশ অর্থাৎ বসন্ত কুমার দাশ আর তার ভাই প্রসন্ন কুমার দাশ। প্রসন্ন কুমার ছিলেন বরিশাল বড়ঘর এস্টেটের জমিদার। এটি ১৯০০ সালের শুরুর দিকের কথা। পরে তিনি ঢাকায় থাকার জন্য এই বিশাল বাড়ি বানানোর উদ্যোগ নেন, যা এলাকাবাসীর কাছে বড়বাড়ি হিসেবে নাম ধারণ করে। বাড়িটিতে ঢুকতে ঘরর...ঘরর... আর ঠুক ঠুক আওয়াজ। নিচতলা, দোতলায় ভাড়া দেওয়া হয়েছে বই বাঁধাই এবং ফার্নিচারের কারখানা। সকাল-বিকাল ভারী মেশিনে বই বাঁধাইয়ের কাজ চলে। এ আওয়াজেই কেঁপে ওঠে নড়বড়ে বাড়িটি। আর তিনতলায় বহু বছর ধরে ভাড়া থাকে একটি পরিবার। দুটি পরিবার আছে নিচতলাতেও। কথা হয় বাড়ির বাসিন্দা পুরু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘শাকিল, বাবু ও মায়া এই তিনজন এখনকার মালিক। তারা আমাদের কাছ থেকে লোক পাঠিয়ে ভাড়া নিতে আসেন। মাঝেমধ্যে লোক ভাঙতে এসে ফিরে যায়। পুরনো এ বাড়ির মালিকরা ভাঙার তিন মাস আগে বাসা ছেড়ে দেওয়ার শর্তে আমাদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন।’ জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পুরান ঢাকার অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার ভারতের কলকাতায় চলে যায়। আবার কলকাতা থেকে অনেক মুসলিম আসেন ঢাকায়। এ সময় কোনো কোনো বনেদি পরিবারের মধ্যে বাড়ি-ভূসম্পত্তির মালিকানা বদল করার সুযোগ ঘটে। বড়বাড়ির মালিক প্রসন্ন কুমার দাশও পেরেছিলেন। বাড়িটি কিনে নেয় পুরান ঢাকার লালবাগের একটি পরিবার। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির এখন ভগ্নদশা। একটি অংশ ইতিমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে। চারপাশ দেখে মনে হয়, যে কোনো সময় বাড়িটি ভেঙে পড়তে পারে বা ভেঙে ফেলা হতে পারে। বড়বাড়িসহ বি কে দাশ রোডের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের সংরক্ষিত সম্পত্তি ছিল। কিন্তু গত বছর ২৯ নভেম্বর রাজউকের সর্বশেষ গেজেটে এখানকার বাড়িগুলোকে সংরক্ষিত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়, যা নিয়ে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলেন, যদিও বড়বাড়ি এখন একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তবু এ রকম শতবর্ষী বাড়ি ঢাকার ঐতিহ্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ রকম বাড়ি না ভেঙে মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সেই চেষ্টাই বরং করা উচিত।

সর্বশেষ খবর