সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

শৈল্পিক বাবুই পাখি

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল

শৈল্পিক বাবুই পাখি

বাবুই পাখি। আমাদের দেশে গ্রাম বাংলায় অতি পরিচিত একটি পাখি। বাবুই পাখির নাম শুনেনি এমন মানুষের দেখা মেলা ভার। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই! আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকার পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে। পাকা হোক তবু ভাই পরের বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।’ কবি রজনীকান্ত সেনের এই কালজয়ী কবিতাটি বাবুই পাখিকে মানুষের অন্তরে গেঁথে রেখেছে। তবে ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার নায়ক গ্রামবাংলার এই নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। আর আগের মতো বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক বাসাও চোখে পড়ে না। পাখি বিশারদরা জানান, বাবুই পাখি Ploceidae গোত্রের অন্তর্গত একদল প্যাসারাইন পাখি। খুব সুন্দর করে বাসা বোনে বলে এরা ‘তাঁতী পাখি’ (Weaver Bird) নামেও পরিচিত। একসময় বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখি দেখা যেত। দেশি বাবুই, দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুই। তবে বাংলা ও দাগি বাবুই এখন বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে দেশি বাবুই বেশি দেখা যায়। এরা খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে দেশের গ্রামগঞ্জের তাল, নারিকেল, খেজুর, রেইনট্রি গাছে দলবেঁধে বাসা বাঁধে। বাসার গঠন বেশ জটিল, তবে আকৃতি খুব সুন্দর। সেই বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়ে বা বাতাসেও টিকে থাকে তাদের বাসা। বাবুই পাখির শক্তবুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কঠিন। বাসা দেখতে উল্টানো কলসির মতো। তারা বাসা বানাবার সময় খুব পরিশ্রম করে থাকে। শুরুতে বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত রাখে। পরে একটি বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা করে নেয়। অন্যটি খোলা রেখে দেয় প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য। রাতে বাসা আলোকিত করার জন্য জোনাকী পোকা ধরে এনে বাসায় রাখে। গ্রীষ্মকাল এদের প্রজনন ঋতু। এ সময় তারা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সাথী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে পুরুষ বাবুই। পুরুষ বাবুই স্ত্রী বাবুইকে নিজের প্রতি আকর্ষণ করাতে খাল-বিল ও ডোবায় গোসল সেরে ফুর্তিতে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। কিছু বাবুই প্রজাতি প্রজনন মৌসুমে তাদের বর্ণের ভিন্নতা প্রদর্শন করে। বাবুই পাখি দুই থেকে চারটি ডিম দেয়। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। তিন সপ্তাহ পর বাচ্চা উড়ে যায়। এরা মূলত বীজভোজী পাখি। তাই এদের ঠোঁটের আকৃতি সহজে বীজ ভক্ষণের উপযোগী চোঙাকার। আর ঠোঁটের গোড়ার দিকটা মোটা। এরা সাধারণত খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন ধরনের বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা, পকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের বিস্তৃতি। সৌল (সেভ আওয়ার আনপ্রোটেক্টেড লাইফ)-এর নির্বাহী পরিচালক তানিয়া খান বলেন, মানুষের অসচেতনতা, পাখি শিকারীদের দৌরাত্ম্য ও গ্রামে গাছপালা কেটে ঘরবাড়ি তৈরির কারণে বাবুই পাখির সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। এ ছাড়া ফসলি জমিতে কীটনাশক প্রয়োগও তাদের কমে যাওয়ার একটি কারণ। বাবুই পাখি এখনো সংকটাপন্ন না হলেও এ অবস্থা চলতে থাকলে সংকটাপন্ন হতে আর বেশি দিন লাগবে না। এদেরকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, মানুষের সচেতনতাই পারে এ পাখির বংশ টিকিয়ে রাখতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর