মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাতের সড়ক মৃত্যুফাঁদ

মির্জা মেহেদী তমাল

রাতের সড়ক মৃত্যুফাঁদ

বাবা হয়েছেন শাকিল আহমেদ। ভীষণ আনন্দ তার। এ্যাপোলো হসপিটালেস মা আর বাচ্চা ভালো আছেন। কিছু জিনিসপত্র আনতে শাকিল হাসপাতাল থেকে কলাবাগানের বাসায় ফেরেন। রাতেই আবার হাসপাতালে যাবেন। টুকটাক কাজ সারতে রাত ১১টা বেজে যায়। কলাবাগানের বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করেন। সঙ্গে বন্ধু পাপ্পুকে নিয়ে সেই রাতে তারা এ্যাপোলো হসপিটালেসর উদ্দেশে রওনা হন। রাস্তা ফাঁকা। শাকিল ধীরেসুস্থে জাহাঙ্গীর গেট হয়ে মহাখালীর ফ্লাইওভার শেষ করে মূল সড়কে উঠে পড়েন। ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আসা দ্রুতগতির একটি কাভার্ড ভ্যান হঠাৎ লেন পরিবর্তন করে ডান দিকে চাপতে থাকে। আকস্মিক ডান দিকে ধেয়ে আসা কাভার্ড ভ্যানটি লুকিং গ্লাসে শাকিলের চোখে পড়ে। তিনি মুহূর্তেই নিজের গাড়িটি আরও ডান পাশে চাপিয়ে দেন। এর পরও শেষ রক্ষা হয়নি। কাভার্ড ভ্যানটি ঠিকই শাকিলের গাড়ির বাঁ পাশের দরজায় আঘাত করে। দরজা চুরমার হলেও প্রাণে রক্ষা পান তারা। শাকিল আহমেদ গাড়িটি দ্রুত ডানে না চাপালেই হয়তো কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। পথচারীরা দৌড়ে এসে কাভার্ড ভ্যান আটকাতে সাহায্য করেন।

কাভার্ড ভ্যানের চালকের আসন থেকে যিনি নামলেন, তাকে দেখে শাকিল আর পাপ্পু হতবাক। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এটা কী করে সম্ভব! মাত্র ১৪ বছরের একটা কিশোর রাজপথে ৩ টনের কাভার্ড ভ্যান চালাচ্ছে! গাজীপুর থেকে দেওয়ান এন্টারপ্রাইজের কাভার্ড ভ্যানে মালামাল লোড করে পুরান ঢাকায় ডেলিভারি দেওয়ার পর টঙ্গী ফিরছিল সে। সে হেলপার হলেও কাভার্ড ভ্যান চালায়। গাড়ি চালানোর কাগজপত্র নেই। সপ্তাহে দু-এক বার এমন দুর্ঘটনা ঘটে তার। সে জানায়, ‘ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আসার পর মূল সড়কে উঠতে গিয়ে ডান দিকে চাপাই ভ্যান। আমি কাভার্ড ভ্য্যানটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। আরেক গাড়িতে লাগিয়ে দিই।’ এ ধরনের হেলপারের কাভাড ভ্যান চালানোর পেছনে রয়েছে আঁতকে ওঠার মতো ভয়ঙ্কর তথ্য। মধ্যরাতে রাজপথে বেপরোয়া যানবাহনের চাপায় প্রায় প্রতিদিনই মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। সর্বশেষ রবিবার দিবাগত মধ্যরাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার কাছে সিমেন্ট কোম্পানির ১০ চাকার মিক্সার ভ্যান পিষে মেরেছে তরুণ মোটরবাইকারকে। মোটরসাইকেলটিও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে। ভ্যানটি সজোরে ধাক্কা মারে মোটরসাইকেলটিকে। তরুণ মোটরসাইকেল চালক ভ্যানের নিচে চলে যায়। এর পরও সে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু ভ্যানচালক পালানোর জন্য সামনের দিকে টান দেয়। এতে ভ্যানের পেছনের চাকা তার ওপর দিয়ে গেলে সেখানেই থেমে যায় তরুণটির হৃত্স্পন্দন। এর আগে উত্তরায় ডাক বিভাগের এক কর্মী, ধানমন্ডিতে নার্সসহ অসংখ্য মানুষের প্রাণ গেছে রাতের রাজপথে। আমতলীতে বাসচাপায় সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হতে হয়েছে এক কিশোরীকে। রাজধানীর রাজপথ রাতের বেলায় মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। ফাঁকা সড়কে দৈত্যের মতো ছুটতে থাকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান আর দূরপাল্লার বাস। যে কোনো সময় এরা হয়ে ওঠে এক একটি মৃত্যুদূত। এদের দানবীয় শব্দে রাস্তার দুই পাশের ভবনগুলো কাঁপতে থাকে। এতে নিরাপদে যারা গাড়ি চালান তারাও প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হন। এই ভয়ঙ্কর অবস্থা চলে সকালে আলো ফোটার আগ পর্যন্ত। জানা গেছে, রাত সাড়ে ১০টার পরই শহরের রাজপথে থাকে না ট্রাফিক পুলিশ। কিছু সিগন্যালে রাত ২টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও আগেই সেখান থেকে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। এর পরই ফ্রিস্টাইল। রাতে চলাচল করা সাধারণ মানুষ বলছেন, রাস্তায় চলতে হয় জীবন বাজি রেখে। রাতে এদের দিকে তাকালে কলিজা ধক করে ওঠে। পুলিশ ও হাসপাতালের তথ্যমতে, রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনার প্রায় ৭০ শতাংশই ঘটে রাতের বেলা।

সরেজমিন পরিদর্শন ও ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাতে ঢাকার রাস্তায় আসা-যাওয়া করা দূরপাল্লার বাসগুলো মহাসড়কের মতোই বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলে। সারা দেশ থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ একই গতিতে ঢুকে পড়ে রাস্তায়। মধ্যরাতের পর বেপরোয়া গতিতে চলে কিছু কিছু প্রাইভেট কারও। কেউ কেউ গাড়ি চালনার প্রশিক্ষণও নেয়। অথচ ঢাকার প্রতিটি বড় রাস্তার সঙ্গেই রয়েছে অলিগলি, যে পথ দিয়ে অহরহ হেঁটে চলাফেরা করে মানুষ। রাস্তায় চলে সিএনজি আটোরিকশা, রিকশা, বাইসাইকেল, রিকশাভ্যানসহ বিভিন্ন ধীরগতির যান। এ কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু রাতের রাজপথের শৃঙ্খলায় নেওয়া হচ্ছে না কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ক্রসিংগুলোয় ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই), সার্জেন্ট (এসআই), এএসআইসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। রাত সাড়ে ১০টার পর সিগন্যাল পয়েন্টগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। এর পরই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। কারণ ফাঁকা রাস্তায় অসচেতন, অনেক ক্ষেত্রে আনাড়ি চালকরা মনমতো গাড়ি চালায়। এখানে আমাদের আসলেই কিছু করার নেই। পরিকল্পনা আসতে হবে ওপর থেকে।’ রাতে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে গিয়ে দেখা যায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রক বাতিগুলোর বেশ কয়েকটি নিভে আছে। চালকরা নিজেরাই দেখেশুনে রাস্তায় মোড় নিচ্ছেন। এক লেনের গাড়ি পার হতে না হতেই ঢুকে পড়ছে অন্য লেনের গাড়ি। সারা রাত শাহবাগ চত্বরে বসে চা-সিগারেট বিক্রি করেন দুখু মিয়া। তিনি বলেন, ‘এখানে রাত ১১টার পর ট্রাফিক পুলিশ থাকে না। রাত ১১টা থেকে আড়াইটার মধ্যে বাংলামোটর, কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়, পান্থপথ, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মহাখালী, কাকলী, মিরপুর রোড ও গাবতলীতে গিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। প্রতিটি বাস ও ট্রাক ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলছিল। গতি নিয়ন্ত্রণ না করেই বিভিন্ন মোড় পার হচ্ছে সেসব গাড়ি। মিরপুর আনসার ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা সজীব ইসলাম বলেন, ‘রাতে ট্রাক যেভাবে চলে তাতে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে ভয় লাগে। মনে হয় ড্রাইভাররা চোখ বুজে গাড়ি চালাচ্ছেন।’ এদিকে চালকদের বেপরোয়া হওয়ার পেছনে দুর্ঘটনার পর তাদের গ্রেফতার না হওয়া একটি বড় কারণ। ছোটখাটো ঘটনা শত শত ঘটছে রাজধানীতে। ব্যবসায়ী শাকিলের গাড়িতে কাভার্ড ভ্যানের আঘাতের বিষয়ের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই কাভার্ড ভ্যানের কিশোর চালকের নাম মাহমুদ হাসান। তার কাছে বাংলাদেশ আন্তজেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের একটি পরিচয়পত্র ছাড়া আর কোনো কাগজপত্র নেই। পরিচয়পত্রের পদবিতে ‘হেলপার’ লেখা রয়েছে। গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। তবে তার কাছে দুই পৃষ্ঠার একটি তালিকা পাওয়া যায়। যেখানে ২০ জন ট্রাফিক সার্জেন্টের নাম রয়েছে। ২০ জন সার্জেন্টের নামের পাশেই তাদের মোবাইল নম্বর ও দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার নাম রয়েছে। কিশোর চালক মাহমুদ হাসান জানিয়েছে, কাভার্ড ভ্যানের মালিক সার্জেন্টের এই তালিকা তার হাতে দিয়ে বলেছেন, ঢাকায় যে কোনো স্থানেই দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো ঝামেলায় পড়লে এলাকা অনুযায়ী সার্জেন্টদের ফোন দিতে হবে। তারাই যে কোনো ধরনের ঝামেলায় সহযোগিতা করবেন। মহাখালী-আমতলীতে সেই রাতেও দুর্ঘটনার পর মাহমুদ হাসান পকেট থেকে তালিকা বের করে ওই এলাকার সার্জেন্টকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করেছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর