বুধবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল বাড়ছে আওয়ামী লীগে

মনিরুল ইসলাম মনি, সাতক্ষীরা

মনোনয়ন নিয়ে কোন্দল বাড়ছে আওয়ামী লীগে

আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাতক্ষীরা-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কেন্দ্রে গ্রুপিং-লবিংসহ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ, উঠান বৈঠক, সভা সমাবেশের মাধ্যমে মাঠের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। তবে প্রকাশ্যে জামায়াত-শিবিরের কোনো দলীয়-কর্মকাণ্ড দেখা না গেলেও মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা ইসলামী জলসা কিংবা ওয়াজ মাহফিলের আড়ালে কৌশলে সংগঠিত হয়ে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে সর্বত্রই চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। আগামী নির্বাচনে মহাজোট আসনটি ধরে রাখার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হলেও বড় সমস্যা মহাজোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে। বর্তমানে এ আসনটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির দখলে। ৯ম সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে চারদলীয় জোটের প্রার্থী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে হারিয়ে নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এবার মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মনে ঘুরে ফিরে একটাই প্রশ্ন, এ আসনে জোটগতভাবে কে মনোনয়ন পাচ্ছেন। বর্তমান এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুত্ফুল্লাহ না জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখত। নাকি আওয়ামী লীগের অন্য কেউ? সাতক্ষীরার তালা ও কলারোয়া দুটি উপজেলার ২৪ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ১০৫ (সাতক্ষীরা-১) আসন। ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৯১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার রয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৮১৮ জন ও পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৩ জন। রাজনৈতিক সহিংসতাপ্রবণ এ আসনে স্বাধীনতার পর থেকে জামায়াতের অ্যাডভোকেট শেখ আনছার আলী ও জাতীয় পার্টির সৈয়দ দিদার বখত একবার করে ও বিএনপির প্রার্থী হাবিবুল ইসলাম হাবিব দুই বার করে জয়লাভ করেন।

বাকি সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এ আসনটিতে। মূলত সে কারণে সাতক্ষীরা জেলায় তালা-কলারোয়া আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। গত নির্বাচনে এ আসন থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুত্ফুল্লাহ।

গত ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক জেলা বিএনপির সভাপতি হাবিবুল ইসলাম হাবিব আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রকৌশলী মুজিবুর রহমানের কাছে পরাজিত হন। গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নুরুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুত্ফুল্লাকে প্রার্থী করা হলে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। অবশ্য ওই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ না নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সরদার মুজিবের সঙ্গে। এ আসনে বিএনপিকে জামায়াতের ওপর ভর করে আর ওয়ার্কার্স পার্টিকে আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কারণে এ আসনটি হয়ে পড়েছে জোট নির্ভর। তবে আসন্ন নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের বিএনপির প্রার্থী হাবিবুল ইসলাম হাবিব মামলা জটিলতায় অথবা কোনো কারণে প্রার্থী না হতে পারলে আর বিএনপির মিত্র জামায়াত তাদের সঙ্গে থাকলে এ আসন থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ প্রার্থী হতে পারেন। সে কারণে স্বস্তিতে নেই বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবও।

এদিকে বিএনপি ও জামায়াতের হারানো এ আসনটি পুনরুদ্ধারে গত চার বছরে দলীয় কোনো কার্যক্রম চালাতে পারেনি তারা। সহিংসতা পরবর্তী শত শত জামায়াত বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা মামলার শিকার হয়ে জেলা হাজতবাসসহ আত্মগোপনে থাকায় প্রকাশ্যে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। এদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ভালো অবস্থানে নেই আওয়ামী লীগও। তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নুরুলের সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনদের দা-কুমড়া সম্পর্ক। উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমান ওয়ার্কার্স পার্টির এমপি ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের দূরত্ব। সব মিলিয়ে তালা উপজেলা আওয়ামী লীগ ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। পার্শ্ববর্তী কলারোয়া উপজেলাতেও একই চিত্র। সেখানে আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপনের সঙ্গে রয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টুর চরম দ্বন্দ্ব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কো স্বীকৃতি পাওয়ায় গত বছর উপজেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠানে দুই গ্রুপের বক্তব্য দেওয়া ও আধিপত্ত বিস্তারকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় পণ্ড হয়ে যায় অনুষ্ঠান। দলীয় নেতা-কর্মী আহতের ঘটনায় মামলায় জড়িয়ে পড়ে উভয় গ্রুপ। কেন্দ্রীয় নেতারা বিরোধ মীমাংসা করলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব এখনো আছে। উপজেলাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কলারোয়া পৌরসভাতে বার বারই বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলীয় কোন্দল নিরসন না হলে এ আসনটি আওয়ামী লীগের জন্য যেমন পরাজয়ের অন্যতম কারণ হতে পারে, তেমনি দলীয় মনোনয়ন থেকেও বঞ্চিত হতে পারে অওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। সে ক্ষেত্রে মহাজোটের ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কপাল খুলতে পারে। 

এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য গণসংযোগসহ কেন্দ্রে জোর লবিং করে যাচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফিরোজ কামাল শুভ্র, তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নুরুল ইসলাম, কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন, ওয়ার্কার্স পার্টির বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট মোস্তফা লুত্ফুল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সরদার মুজিব, জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক সাবেক মাগুরা ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অনিত মুখার্জি, জাতীয় পার্টির সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখত, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ ওবায়েদুস সুলতান বাবলু, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে বিএনপির মিত্রদল জামায়াতের সঙ্গে জোট না হলে এ আসন থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য মাঠে কাজ করায় দলীয় কোন্দল চরমভাবে দেখা দিয়েছে। একজন প্রার্থী তাদের অপর দলীয় প্রার্থীর চরম সমালোচনা করায় বিপাকে পড়েছে তৃণমূলের দলীয় কর্মীরা।

আওয়ামী লীগের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুত্ফুল্লাহ জানান, ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী খুনসহ যে তাণ্ডব চালিয়েছিল সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কঠোর ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। এমপি হওয়ার পর যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে অন্য বারের তুলনায় সরকার এ আসনে বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নূরুল ইসলাম বলেন, এ আসনটি মহাজোটের দখলে আসলেও বর্তমান ওয়ার্কার্স পার্টির এমপির কাছে উন্নয়ন নিয়ে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ঘাটতি আছে। এবার আর শরিক নয়, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

এদিকে আওয়ামী লীগের নতুন মুখ হিসেবে মাঠে কাজ করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন। শেখ হাসিনার উন্নয়নমূলক ব্যানার ফেস্টুনে শুধু তালা-কলারোয়ার নির্বাচনী এলাকাসহ ছেয়ে ফেলেছেন পুরো জেলা। তিনি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাতক্ষীরা ঢাকাস্থ আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি। দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলা-মোকদ্দমাও বিনামূল্যে দেখাশোনা করছেন। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন জানান, দলের উচ্চ পর্যায়ে তার কথা হয়েছে। কেন্দ্রের গ্রিন সিগনালেই তিনি এলাকায় কাজ করছেন।

সর্বশেষ খবর