বুধবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য-২৭

বদলে গেছে নাজিমউদ্দিন রোডের সেই চিত্র

মাহবুব মমতাজী

বদলে গেছে নাজিমউদ্দিন রোডের সেই চিত্র

নীরব সুনসান পরিবেশ ফিরে এসেছে এলাকাটিতে। অনেকটা স্বাভাবিক। বাসিন্দারা বলছেন, আমরা এখন অনেকটা শান্তিতে আছি। নেই কোনো কোলাহল ও যানজট। ধীরে ধীরে আমরা নিরিবিলি বাসযোগ্য পরিবেশ ফিরে পাচ্ছি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের পর বদলে গেছে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের চিত্র। একই সঙ্গে বদলে গেছে কারা স্থাপনার লাল রং বা লাল দালানের কথাটিও। কারাগারের সামনের সড়কে এখন আর বন্দীদের স্বজন কিংবা সংশ্লিষ্টদের চিরচেনা ভিড় চোখে পড়ে না। আসা-যাওয়া নেই প্রিজন ভ্যানের। নেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীদের তেমন উপস্থিতি। নেই বন্দীরাও। আশপাশের বাসিন্দাদের কাছে এটি এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তবে সব নিরাপত্তা একমাত্র বন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা একটু বেশি। খালেদা জিয়াকে আনার আগে এ সংখ্যা নগণ্যই ছিল। স্থানীয় এক দোকানদার জানান, এখন এলাকাটি খালি খালি লাগে। নতুন এই দৃশ্যপটে অনেকে খুশি হলেও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে কিছু ব্যবসায়ীকে। কারাগারকেন্দ্রিক লোকসমাগম কমে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে কারাগারটি স্থানান্তরের পরেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের ‘গলাকাটা’ দাম নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তারা বন্দীদের স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন জিনিসের দাম নিতেন প্রায় তিনগুণ। দেখা করার সময় ব্যাগ ও মোবাইল রাখা বাবদ রাখতেন আরও নির্দিষ্ট ফি। কোনো কোনো সময় তা গায়েব করে দিতেন। এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী নাজিমউদ্দিন রোড।

২০১৬ সালের ২৯ জুলাই এখান থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে স্থানান্তর করা হয়। কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের সময় বন্দী ছিল ৬ হাজার ৫১১ জন। একদিনেই ফাঁকা হয়ে যায় ২৩০ বছরের ঐতিহাসিক পুরনো কারাগারটি। জানা যায়, ১৭৮৮ সালে স্থাপিত পুরনো কারাগারটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী। পুরনো কারাগারের বর্তমান স্থাপনার মধ্যে আছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যেমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়ানি সেলে। তার সেই স্মৃতি ধরে রাখতে দেওয়ানি সেলকে ‘বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি জাদুঘর’-এ রূপান্তর করা হয়। এই জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের ইতিহাস জানাতে এখানে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়। সেলের সামনে জাদুঘর প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লাগানো একটি কামিনী ফুল গাছ ও একটি সফেদা গাছ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে সেলে নৃশংসভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়, সেই সেলও সংরক্ষণ পরিকল্পনায় আছে।

 ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার স্মৃতি জাদুঘর উদ্বোধন করেন। গতকাল দুপুরে নাজিমউদ্দিন রোডসহ কারাগারের চারপাশের সড়ক ঘুরে দেখা যায়, অল্প কিছু রিকশা চলাচল করছে। কোথাও আগের মতো যানজট নেই। কারাগারের সামনে অপেক্ষমাণ কয়েকজন রিকশাচালক জানালেন, অন্যান্য দিনের তুলনায় যাত্রী পাচ্ছেন কম। চানখাঁরপুল থেকে মৌলভীবাজার এবং চকবাজারে রাস্তাটিতে রিকশা-ভ্যান চলাচল করলেও নেই আগের সেই চিনচেনা জট। চলছে রাস্তার ড্রেনেজ লাইন মেরামত আর খোঁড়াখুঁড়ি। অনেকটা শীতল আশপাশের পরিবেশ। আগের মতোই আছে কারাগারের ফটকটি। ‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ স্লোগানের একটু নিচে ডিজিটাল ঘড়িটি তার সময় গণনা করেই চলছে। পরিত্যক্ত পড়ে আছে অনুসন্ধান কক্ষ। বন্দী স্বজনদের নাম ধরে ডাকার সেই মাইকটি আছে ঠিক আগের জায়গাতে। বন্ধ হয়ে যাওয়া বেকারিটি এখন ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড কাবাব। রাস্তার পাশের চা দোকানি নয়ন জানান, তার দোকানের বিক্রি অনেক কমে গেছে। বন্দীরা থাকাবস্থায় গড়ে দেড় হাজার টাকার বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হয় ৫০০ টাকার মতো। আর যখন কাউকে ফাঁসি দেওয়া হতো এ খবরের পর তিন দিন ধরে আমরা দোকানপাট তেমন খুলতাম না। কারণ ওই সময় এক ধরনের ভয় কাজ করত। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির সময়টায়। আবার আইনশৃঙ্খলা এবং গোয়েন্দা বাহিনীর নানা প্রশ্নের ঝামেলায় পড়তে হতো। আর ফাঁসির দিনের পরিবেশ থাকত বেশ গরম। স্থানীয় বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, কারাগার সরানোয় ভালো হয়েছে। জায়গাটা আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়েছে। চলাচল করতেও অনেক ভালো লাগে। বন্দী আত্মীয়-স্বজনের অনেক আহাজারি চলেছে নাজিমউদ্দিনের তিন রাস্তার মোড়ে। সেই বিদারক দৃশ্য আর নেই।  কারা অধিদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুরনো কারাগারটিতে স্মৃতির জাদুঘর ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করতে ৫৩২ কোটি টাকা চেয়ে একটি প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সেটা নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছে। প্রকল্পটি এক বছরের জুন-জুলাইয়ে শুরু হলে শেষ হতে আড়াই তিন বছর লাগতে পারে।

সর্বশেষ খবর