শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রভাবশালীদের দখলে কক্সবাজারের বাকখালী নদী

অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে নদী। নদী বাঁচাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ৩০তম পর্ব আজ।

আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার

প্রভাবশালীদের দখলে কক্সবাজারের বাকখালী নদী

কক্সবাজার জেলার প্রধান নদীগুলো হচ্ছে বাঁকখালী, মাতামুহুরী, রেজু, নাফ ও কোহেলিয়া। নির্বিচারে পাহাড় নিধন, দখল ও দূষণের কারণে জেলার প্রধান নদীগুলো এখন তীব্র নাব্যতা সংকটে রয়েছে। পাশাপাশি প্রভাবশালী মহলের দখলবাণিজ্যের কারণে নদীগুলোর পরিধিও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। দখল ও দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি নাব্যতা সংকটে রয়েছে জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঁকখালী নদী। শুধু দখলবাণিজ্যের কারণে বাঁকখালী নদীটির অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত পরিবেশবাদীরা। এ কারণে নদীটিকে নৌবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার সরকারি পরিকল্পনাও ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০১০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে নৌবন্দর নির্মাণে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট থেকে মহেশখালী চ্যানেল পর্যন্ত দুই পাড়ের এক হাজার ২০০ একর জমিতে নৌবন্দর প্রতিষ্ঠায় আনুুষঙ্গিক কাজও শেষ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তবে দখলে থাকায় জেলা প্রশাসন জমি বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে নৌবন্দর স্থাপনের কাজ পিছিয়ে পড়ছে। বিআইডব্লিউটিএর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের মে মাসে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে বাঁকখালী নদীর সীমানা নির্ধারণে জরিপ চালায়। জরিপের পর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নদীর দুই পাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। তবে নৌবন্দরের জন্য নির্ধারিত জমি বুঝিয়ে দিতে না পারায় মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সম্প্রতি অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে তারা। বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) নয়ন শীল বলেন, কক্সবাজারে প্রস্তাবিত নৌবন্দরের জন্য নদীতীরবর্তী জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছে। দখলমুক্ত করতে না পারায় নৌবন্দরের গেজেট প্রকাশের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরু করা যায়নি। নৌবন্দর বাস্তবায়িত হলে সরকারি কোষাগারে বছরে ১০-১৫ কোটি টাকার রাজস্ব জমা হতো। জানা গেছে, বাঁকখালী নদী দখলের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা। ১৫টি প্রতিষ্ঠান নদী দখল করে শুঁটকি, হ্যাচারি, কাঁকড়া ও মাছের খামার গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া ১০টি ভবন নির্মাণ করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া প্রদান করেছে প্রভাবশালীরা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা নদী দখল করে বসতি ভাড়া দিয়েছেন। মূলত নদীর দুই তীরে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্থাপনা থাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবাদীরা। বিআইডব্লিউটিএর তালিকার তথ্য থেকে জানা গেছে, নদীর পাড় দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ, ফ্লাওয়ার মিল, ফিশারিজ, ফিশ অফিস, হ্যাচারি, কোল্ডস্টোরেজ, অ্যাগ্রো ফার্ম, বরফকল, দোকান ও বাসা ভাড়া দিয়েছেন প্রভাবশালীরা। অনেকেই নদীর মধ্যে সীমানা তৈরি করে ভবন তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে নদীর দখলদারদের তালিকা তৈরি ও ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। বর্তমানে সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে। উচ্চ আদালতে মামলার কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা যাচ্ছে না। ২০১১ সালের ১৮ মে সম্ভাব্য জমি হস্তান্তরের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় বিআইডব্লিউটিএ। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় নিরুপায় জেলা প্রশাসন। দখলদারদের তালিকা তৈরি হলেও রাজনৈতিক নেতাদের নাম থাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় গতি নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার সরেজমিন বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট, পেশকারপাড়া ও ছয় নম্বর জেটিঘাট ঘুরে দেখা গেছে, শহর থেকে পৌরসভার ট্রাকে করে আবর্জনা এনে ফেলা হচ্ছে নদীতে। ঘাট এলাকায় দখল ও আবর্জনা ফেলায় নদীর প্রস্থ অর্ধেকেরও বেশি অংশ ভরাট হয়ে গেছে। শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া থেকে মাঝেরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার তীরবর্তী এলাকায় ভরাট ও দখল তৎপরতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। কস্তুরাঘাটের বিআইডব্লিউআইটি টার্মিনাল-সংলগ্ন নদীর ভরাট জমিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে চিংড়ি ঘের, লবণ উৎপাদনের মাঠ, প্লট বিক্রির হাউজিং কোম্পানি, নৌযান মেরামতের ডকইয়ার্ড, ময়দা ও বরফকল, শুঁটকি মহালসহ অসংখ্য টিনশেডের বসতঘর। প্রভাবশালীদের দখল-দৌরাত্ম্যে বাঁকখালী নদীর অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর