মঙ্গলবার, ১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

শেরপুরে আট নদী বিলীন

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। অথচ অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে নদী। নদী বাঁচাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ৩২তম পর্ব আজ।

মাসুদ হাসান বাদল, শেরপুর

শেরপুরে আট নদী বিলীন

শেরপুরের প্রায় দেড়শ বছর আগের ইতিহাসে ১৬টি প্রধান নদী ও ৯টি ক্ষুুদ্র নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম আছে সেগুলো হলো— ব্রহ্মপুত্র, মালিঝি, সোমেশ্বরী, মৃগী, নেত্রবতী, মহাঋষি, থলঙ্গ, ভোগবতী, খারুয়া, দর্শা, ভুরাঘাট, বলেশ্বরী, সুতী, মরাখড়িয়া, বৃদ্ধ ভোগবতী ও খড়িয়া। এগুলোর ৮টিই বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ৮টি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো কোনো রকমে বেঁচে আছে। যে ৮টি নদী কোনো রকমে টিকে রয়েছে তার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী, সোমেশ্বরী ও মালিঝি আগের নামেই এখনো পরিচিত। ৪ নদীর নাম পরিবর্তন  হয়েছে। সেগুলো হলো ভোগবতী থেকে ভোগাই, মহাঋষি থেকে মহারশি, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালি এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অপরদিকে ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টিও হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শেরপুরের এক সময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী নেতাই খালে রূপান্তরিত হয়। তারপর একেবারেই হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম এ নদীর নাম এখন আর জানে না। অথচ এ নদীটি সাবেক শেরপুর পরগণার মধ্যে ৪৩ মাইল দীর্ঘ নদ ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। এ ছাড়া মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালি ১২ মাইল, সোমেশ্বরী সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি ১৫ মাইল এবং ভোগাই নদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিল। আর নকলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতী নদীকে ঘিরে ব্রিটিশ আমলে চন্দ্রকোণায় গড়ে উঠেছিল বিশাল বন্দর। আজ সেটি প্রভাবশালীদের মত্স্য খামার। শেরপুর-জামালপুর অংশের ব্রহ্মপুত্র পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ নাম ধারণ করে। এই বহ্মপুত্র নদ শেরপুর জেলার বিশাল চরাঞ্চলের আর্শীবাদ ছিল। কালের পরিক্রমায় আজ নদীটি ছোট একটি খালের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতি বর্ষায় এটি অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। তখন ব্রহ্মপুত্র নদ আগ্রাসী রূপ ধারণ করে চরাঞ্চলকে বন্যায় ভাসিয়ে ক্ষতবিক্ষত  করে দেয়। এ ছাড়া ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা পাহাড় থেকে কংস নদীর জন্ম হয়ে শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতে এর নাম কংস হলেও শেরপুরের নালিতাবাড়ীর হাতিবাগারে এসে এ নদীর নাম হয়েছে ভোগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ কিলোমিটার ভাটিতে এসে নদীটি দিংঘানা, চেল্লাখালি, মহাররি, মালিঝি ইত্যাদি বাহারি নামে উপনদীর নাম ধারণ করে আবার ভোগাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভোগাই ময়মনসিংহের ফুলপুরের খড়িয়া নদীর সঙ্গে মিশেছে। খড়িয়া নদী ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। জানা গেছে, দীর্ঘদিনের দখল আর নানা উৎপাতেই নদীগুলো স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। ফলে পাহাড়ি ঢলের প্রবল সে াত দুই কূল ছাপিয়ে ভোগাই, চেল্লাখালি, সোমেশ্বরী, মহারশি নদী রুদ্ররূপে আবির্ভূত হয়। প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালি-পলিতে ভরাট হয়েছে নদ-নদীগুলো। খননের অভাবে জেলার প্রায় সব নদীতেই এখন পানির সংকট। পানি না থাকায় নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে চলাচল করেন পথচারীরা। তাছাড়া পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে উজান থেকে আসা বালির আস্তরণ পড়ে ভাটির দিকের শত শত একর ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। অপরদিকে অপরিকল্পিত এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলেও মরে যাচ্ছে নদ-নদী। তাছাড়া উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর  স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইস গেট নির্মাণের ফলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এতে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চলেছে। এসব নদী খননে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় নাব্য হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। নদীতে জেগে উঠেছে চর। সেই চরও আবার দখলে রয়েছে প্রভাবশালীদের হাতে। তারা নদীর বুকে করছে চাষাবাদ, গড়ে তুলছে বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।  তবে নদীগুলোকে বাঁচাতে গত ১১ এপ্রিল জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বৈঠক করে ৭ দফা দাবি জানিয়েছে শেরপুর পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জনউদ্যোগ। পবা ও জনউদ্যোগের ভাষ্য— ‘আমাদের নদী আমাদেরই বাঁচাতে হবে।

নদী সুরক্ষায় সরকার, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিক, নাগরিক সমাজকে মিলে এটা করা সম্ভব। তাই নদী সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও নদী সুরক্ষায় সংগঠিত হওয়া জরুরি। সম্মিলিত উদ্যোগ ও সক্ষমতা আমাদের নদী বাঁচাতে সহায়তা করবে।’ এ ব্যাপারে শেরপুর ও জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, সারা দেশের নদী সংস্কার ও দখল ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারের কাছে ৭০ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প জমা দিয়েছে। প্রকল্প পাস হলেই নদী সংস্কার ও দখলমুক্ত করা হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর