শনিবার, ৫ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

নখদন্তহীন বাঘ ইউজিসি

আকতারুজ্জামান

নখদন্তহীন বাঘ ইউজিসি

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ২০১৪ সালের জুনে ‘সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনে সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতিহীন কার্যক্রম উঠে আসে। এ প্রতিবেদনের সত্যতা জানতে তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নূর উন নবীকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটি-প্রদত্ত প্রতিবেদনে বলা হয়— ইউজিসি এক নখদন্তহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা অনিয়ম করলেও উচ্চশিক্ষার তদারক করার এ সংস্থা শুধু বাঘের মতো হুঙ্কার দিতে পারে, কিন্তু কামড় দিতে পারে না। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা ছাড়া কিছুই করতে পারে না ইউজিসি। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইউজিসি গঠন করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মোট ছয়টি। ৪৪ বছর পর এখন দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি ৪০টি ও বেসরকারি ১০১টি। কিন্তু এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তদারকের জন্য ইউজিসির ক্ষমতা বাড়েনি। ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলছেন, উচ্চশিক্ষা কমিশন না থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। ইউজিসি এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করলেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। চেয়ারম্যান বলেন, ইউজিসিকে কমিশনে রূপ দেওয়া হলে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে। তাই ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপ দেওয়া সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার গুণগতমান বজায় থাকবে। তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ইউজিসি কাজ করতে চায়। ইউজিসি সূত্র জানায়, ইউজিসি প্রতিষ্ঠার সময় ’৭৩ সালে উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ হাজারের মতো। এখন প্রায় ৩৫ লাখ। কালক্রমে উচ্চশিক্ষায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় দেড় শ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা করার সক্ষমতাও নেই ইউজিসির। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারকি সংস্থা হিসেবে দায়িত্বে থাকলেও তেমন কোনো ক্ষমতা নেই এর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এই ইউজিসি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়েপাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে।

কিন্তু ওই রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর হাওয়া হয়ে যায়। ফাইলও লাপাত্তা হয়ে যায়, এমন অভিযোগ করেন অনেকে। জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউজিসিকে কমিশনে রূপ দিতে কার্যক্রম শুরুর নির্দেশনা দেন। কেউ কেউ বলছেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে নয় মাসে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর নয় বছরেও উচ্চশিক্ষা কমিশন করা সম্ভব হয়নি। এরপর বিভিন্ন সময় কৃতী শিক্ষার্থীদের স্বর্ণপদক প্রদানের অনুষ্ঠানেও ইউজিসির ক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। গত বুধবারেও এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ইউজিসির সক্ষমতা বাড়ানো দরকার, যাতে তারা সব উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শিক্ষার মান যাতে বজায় থাকে এজন্য ইউজিসিকে শক্তিশালী করতে হবে। সূত্র জানায়, গত অক্টোবরে ইউজিসিতে সংস্থাটির সক্ষমতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত এক বৈঠকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতে ইউজিসির ৩১টি দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে সেখান থেকে ১৫টি ‘ক্ষমতা’ বাদ দিয়ে ১৬টি নির্ধারণ করে মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়েছিল। এ প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানান, পাশের প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান বজায় রাখতে উচ্চশিক্ষা কমিশন রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১৪টি দেশে উচ্চশিক্ষা কমিশন রয়েছে। ফিজি, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো দেশেও রয়েছে উচ্চশিক্ষা কমিশন। কিন্তু আমাদের দেশ নানা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেও এখনো উচ্চশিক্ষা কমিশন করা হয়নি। সূত্র বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কারণে প্রতিনিয়তই উচ্চশিক্ষার বিস্তার ঘটছে। ইউজিসির ক্ষমতা বৃদ্ধি করা না গেলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে উচ্চশিক্ষা কমিশন করা জরুরি। উচ্চশিক্ষার স্বার্থে ইউজিসিকে অবিলম্বে কমিশনে রূপ দেওয়া উচিত। দেশের বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইনের কোনো তোয়াক্কা না করেই চলছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে ইউজিসির এক কর্তাব্যক্তি বলেন, ইউজিসিকে দুই পয়সার দাম দেয় না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ পেয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে ইউজিসি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ইউজিসি কোনো কথা বললেও তারা কর্ণপাত করে না।  ইউজিসি শুধু কেরানির কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, তিনি চেয়ারম্যান থাকতে উচ্চশিক্ষা কমিশন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কমিশন হলে মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব কমে যাবে এমন আশঙ্কা থেকে কে বা কারা এ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করছেন। তিনি বলেন, ইউজিসির বর্তমান কাঠামোও এত বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করার জন্য যথেষ্ট নয়। উন্নত দেশের কাতারে এ দেশের ধারা ত্বরান্বিত করতে উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক ইউজিসিকে কমিশনে রূপ দেওয়ার বিকল্প নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউজিসিকে উচ্চশিক্ষা কমিশনে রূপ দেওয়ার কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন। বিষয়টি শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর