শনিবার, ৫ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রূপপুর পদ্মা পাড়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ

পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র ঘিরে গড়ে উঠছে নতুন শহর । থাকছে ২০ তলা বিল্ডিং, মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

রূপপুর পদ্মা পাড়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ

পাবনার রূপপুরে পদ্মার পাড়ে এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। দ্রুতগতিতে চলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ কাজ। আর এই বিদ্যুেকন্দ্র ঘিরে গড়ে উঠছে নতুন শহর। একই সঙ্গে চলছে প্রকল্প- সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রমও। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনে বর্তমানে রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ৬০০ বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন প্রকল্প এলাকায়। এ ছাড়া সেখানে বিভিন্ন কাজে দৈনিক প্রায় ২ হাজার মানুষ কাজ করছেন। এমন কি রাতের বেলাতেও ৩০০ থেকে ৪০০ জনবল কর্মরত থাকেন ওই প্রকল্পে। লক্ষ্য একটাই ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এই প্রকল্পের কাজ শেষ করা, যেখান থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। গত ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের মূল কাজের (পারমাণবিক চুল্লি বসানোর জন্য ঢালাই) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর কাজের গতি আরও বেড়ে গেছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণ, প্রকল্প এলাকায় আবাসন তৈরি, বৈদ্যুতিক সংযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ফায়ার স্টেশন স্থাপন, প্রকল্প এলাকায় মালামাল পরিবহনসহ নানা বিষয়ে সমন্বয় তৈরি করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে প্রকল্পের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কার্যক্রম এমনভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে, যাতে কোনো কাজের জন্য অন্য একটি        কাজ আটকে না থাকে। মূল কাজের সঙ্গে একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ কাজও। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর এরই মধ্যে প্রথম ইউনিটের ঢালাই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন এই ইউনিটের রি-অ্যাক্টর বিল্ডিংসহ অন্যান্য স্থাপনার কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া ২য় ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লির ঢালাই কাজ শুরু করতে ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন লাইসেন্সের জন্য এরই মধ্যে পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। লাইসেন্স পাওয়া গেলে চলতি মে থেকে জুনের মধ্যে ২য় ইউনিটের ঢালাই কাজ শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রকল্প পরিচালক।

কর্মকর্তারা জানান, মূল কাজ বাস্তবায়নের আগেই সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের গ্রিডলাইন এবং সাব-স্টেশন নির্মাণ কাজ ২০২০ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রিনসিটি আবাসন প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। 

ভূমি অধিগ্রহণ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রাথমিকভাবে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছিল। কিন্তু তা পর্যাপ্ত না হওয়ায় আরও ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া আরও ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯০ একর খাস জমির বিষয়ে হাই কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়ের অব্যবহূত ভূমি প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনের অনকূলে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

গ্রিনসিটি আবাসন : প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে তৈরি হচ্ছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। পাবনা গণপূর্ত অধিদফতর এ কাজ বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যেই তিনটি সুউচ্চ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে গ্রিনসিটি আবাসন এলাকায় ৫টি ভবন সম্পূর্ণ নির্মাণ করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই বিদ্যুেকন্দ্রে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ তলা ১১টি বিল্ডিং এবং ১৬ তলা ৮টি বিল্ডিংয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ ভবন তৈরি হবে এ চত্বরে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুেকন্দ্র ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন শহর। যে শহরে থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

বিদ্যুতায়ন : বিদ্যুেকন্দ্রের গ্রিডলাইন এবং সাবস্টেশন নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট কাজ আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প সাইট এবং প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো)। বিশেষ করে গ্রিনসিটি এলাকার বিদ্যুতায়নের কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

মালামাল পরিবহন : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের মালামাল পরিবহনে নৌপথকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ভারী যন্ত্রপাতি চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে আনার পর নৌপথে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছানো সহজ ও নিরাপদ হবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এজন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে বেশ কিছু নির্দেশানও দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে রূপপুর, পাকশী পর্যন্ত নৌপথের মাধ্যমে প্রকল্পের মালামাল সুষ্ঠুভাবে পরিবহনের জন্য নেভিগেশন চ্যানেল মার্কিং করতে বলা হয়েছে। পাটুরিয়া থেকে পাকশী পর্যন্ত যেসব স্থানে ড্রেজিং প্রয়োজন সেখানে ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

রেলপথ নির্মাণ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ কাজের ভারী মালামাল প্রকল্প এলাকায় পৌঁছানোর জন্য ২২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মিত হচ্ছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৯ কোটি টাকা। পৃথক এ রেললাইন ঈশ্বরদী বাইপাস টেক অব পয়েন্ট থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র পর্যন্ত যাবে। এর বাইরেও একটি ‘বি’ শ্রেণির রেলওয়ে স্টেশন, সাড়ে চার কিলোমিটার লুপ লাইন, সাতটি কালভার্ট, গেটসহ সিগন্যালিং ব্যবস্থাসহ ১৩টি লেভেল ক্রসিং থাকছে।

অগ্নি নিরাপত্তায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি কর্মকাণ্ডের আওতায় একটি স্বতন্ত্র, স্বয়ংসম্পূর্ণ অত্যাধুনিক ফায়ার স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আওতায় এটি পরিচালিত হবে। ফায়ার স্টেশন স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুেকন্দ্রের নিজস্ব জনবলকে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কাজে সহায়তা প্রদানের জন্য ফায়ার ব্রিগেডের ৩/৪ জন সদস্যকে অন্তর্বর্তীকালীন ডেপুটেশনে পদায়নের জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগে প্রস্তাব পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নিউক্লিয়ার ইনফরমেশন সেন্টার : পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন করতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের আবাসিক এলাকা গ্রিনসিটি-সংলগ্ন স্থানে ‘নিউক্লিয়ার ইনফরমেশন সেন্টার’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানির (এনপিসিবিএল) অর্থায়নে এটি স্থাপিত হবে।

অত্যাধুনিক স্থাপত্য নকশায় সেন্টারটি জনগণের কাছে নান্দনিক এবং আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া প্রকল্প সাইটের নিকটবর্তী এলাকায় গতিসীমা সীমিতকরণ, চেকপোস্ট, যাত্রীছাউনি এবং প্রকল্প সাইটে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক সংযোগের বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর