সোমবার, ৭ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
শেষ হলো ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক

ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহই পারে রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রতিরোধ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

সক্ষমতার প্রমাণ দেখিয়ে অনন্য ব্যবস্থাপনায় শেষ হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক আয়োজন ওআইসির ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। গতকাল বিকালে ঢাকা ঘোষণা প্রকাশ ও যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পর্দা নামে দেশীয় কূটনীতির ল্যান্ডমার্ক এ আয়োজনের। এর আগে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর এ জোট গ্রহণ করে বিভিন্ন ধরনের ১২০টি রেজ্যুলেশন। মিয়ানমার, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় নির্যাতনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়, সংস্থা হিসেবে ওআইসির জরুরি সংস্কার, নারীর ক্ষমতায়ন ও তারুণ্যের উন্নয়নে ২০টিরও বেশি প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচন করেছে এ সংস্থার বিশেষ কমিটি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনার শীর্ষে থাকা রোহিঙ্গা ইস্যুটি মুসলিম বিশ্বের অনৈক্যের কারণে দুর্বলতার কথাটি আরেকবার সামনে নিয়ে এসেছে। বলা হয়েছে, মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকাই পারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের মতো মানবিক সংকটকে মোকাবিলা করতে। জাম্বিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে রোহিঙ্গা নির্যাতনকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে মন্ত্রী মর্যাদার ওআইসির অ্যাডহক কমিটি করার। আর রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য একটি ত্রাণ তহবিল গঠনের জন্য রেজ্যুলেশন এনেছে সুদান। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার-বিসিসিআইতে গত শনিবার সকালে শুরু হওয়া সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিনের আনুষ্ঠানিকতা গতকাল সকালে শুরু হয় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ সেশনের মাধ্যমে। ওআইসি ফরেন মিনিস্টার কাউন্সিলের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে বিশেষ এ সেশনে উন্মুক্ত আলোচনায় জিবুতি, ইরান, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরাক, মালয়েশিয়া, মিসর, তুরস্ক, কাজাখস্তান ও সুদানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বক্তব্য দেন কানাডার প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গাবিষয়ক বিশেষ দূত বব রে, জাতিসংঘের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি  জেনারেল রশিদ খালিকভ, ওআইসির ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের সভাপতি ড. রাশিদ আল রালুশি ও আরাকান ইউনিয়নের প্রতিনিধি ড. ওয়াকার উদ্দিন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঞ্চালনায় এ বিশেষ সেশনে জাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এন ওসাইনু দারবো জবাবদিহিতা নিশ্চিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য বিশেষ কমিটির প্রস্তাব করেন। রেজ্যুলেশনে বলা আছে, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য দোষীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে ওআইসির অ্যাডহক মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করবে। গত বছর ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধগুলোর দায়বদ্ধতার জন্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা এবং মানবাধিকার পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ নিশ্চিত করাই হবে এ কমিটির কাজ। বাংলাদেশসহ ওআইসির সদস্য বেশকিছু দেশ এতে সমর্থন দিয়েছে। তবে এই প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে একটি সংশোধনী চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ’ এর ‘অপরাধের’ পরিবর্তে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শব্দটির প্রতিস্থাপিত করে সংশোধনী চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এই সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিশেষ এই সেশনে দেওয়া বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ এম মাহমুদ আলী বলেন, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত চুক্তি করেছি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য আমরা তৈরি। তবে সমস্যা হচ্ছে ফেরত পাঠানোর জন্য তাদের যে বাড়িঘর তা এখনো তৈরি করা হয়নি। কানাডার বব রে বলেন, ‘আমি যখন কক্সবাজার সফর করেছিলাম তখন রোহিঙ্গারা বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন যেন আমি বিশ্বকে বলি তারা মানুষ। কানাডা দায়বদ্ধতার নীতিতে বিশ্বাসী এবং আমরা জানি এটি জটিল একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। জাতিসংঘের অ্যাসিস্ট্যান্ট  সেক্রেটারি জেনারেল রশিদ খালিকভ বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করছে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ। রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু এবং অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ওআইসির ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের সভাপতি ড. রাশিদ আল রালুশি বলেন, ‘আমরা ২০১১ সাল  থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে আলোচনা করছি। আমাদের একটি সুপারিশ আছে, রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি বিশেষ পাথ ফাইন্ডিং কমিশন গঠন করা। তিনি দ্রুত মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার দাবি জানান। রোহিঙ্গাদের অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা ওয়াকার উদ্দিন বলেন, ‘আমার জন্ম রাখাইনে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এ ধরনের অত্যাচার আমি জন্ম থেকে দেখে আসছি। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার আহ্বান জানাই।’ উন্মুক্ত আলোচনায় জিবুতির প্রতিনিধি বলেন, ‘আমি ৪-৫ বছর আগে রাখাইনে গিয়েছিলাম। আমি তাদের দুঃখ-কষ্ট নিজ চোখে দেখে এসেছি।’ ইরানের প্রতিনিধি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে টেকসই উপায়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর। উগান্ডার প্রতিনিধি বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার ও শান্তিপূর্ণ বসবাসের অধিকার আছে।’ ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘আমাদের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।’ পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বিষয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছি।’ ইরাকের প্রতিনিধি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মানুষ। মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই তাদের মানবাধিকারকে সম্মান করার।’ মালয়েশিয়া প্রতিনিধি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের এ বিষয়ে বড় ভূমিকা আছে।’

ঢাকা ঘোষণায় শেষ : ওআইসির মহাসচিবকে সঙ্গে নিয়ে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বিকালে যৌথ সমাপনী সংবাদ সম্মেলন করেন। এটাই ছিল সম্মেলনের শেষ আনুষ্ঠানিকতা। কাউন্সিল চেয়ারম্যান মাহমুদ আলী বলেন, বিশেষ সেশনে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সব দেশই এবং তারা প্রশংসা করেছে বাংলাদেশের ভূমিকার। মূল সম্মেলনের সাইডলাইনে ৪০টির বেশি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তথ্যও জানান কাউন্সিল চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সম্মেলনের উদ্বোধন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওআইসির সংস্কারে ৫টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন। অতিথি কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দেন রোহিঙ্গা নির্যাতনকারীদের জবাবদিহিতার ওপর।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ৫৮ দেশ ও ৫২টি সংস্থার মোট ১১০টি প্রতিনিধি দলের প্রায় ৬০০ প্রতিনিধির অংশগ্রহণে সম্মেলন সফলতার সঙ্গে শেষ হলো। অংশ নেওয়া মোট ৫৮টি দেশের মধ্যে ৫৩টি সদস্য দেশ, ৩টি পর্যবেক্ষক দেশ ও ২টি অতিথি। ২২ জন মন্ত্রী, ১৩ জন প্রতি ও উপমন্ত্রী, ৬ জন পররাষ্ট্র সচিব ও ১৬ জন রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন।

বাংলাদেশের চার রেজ্যুলেশন গ্রহণ : ওআইসির কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নতুন চারটি রেজ্যুলেশন এবারের সম্মেলনে গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হলো— কানেকটিভিটি বাড়িয়ে আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ওআইসির ব্যাপক সংস্কার (তুরস্কের সঙ্গে যৌথ) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ চেয়ার স্থাপন।

সর্বশেষ খবর