সোমবার, ৭ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

জীবন শুরুতেই শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

জীবন শুরুতেই শেষ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়। এরপর প্রেম। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একটি বাসায় ভাড়া ছিলেন ছয় মাস। সেই বাসা থেকে প্রেমিকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, খুলনার সোনাডাঙ্গার গোবরচাকা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় ছয় মাস ধরে ‘বিবাহিত’ পরিচয়ে থাকতেন মো. রাশেদুজ্জামান ও তার প্রেমিকা। এক সকালে ওই বাড়ি থেকে রাশেদুজ্জামানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থল থেকে যুবকের মৃতদেহ উদ্ধারের পাশাপাশি প্রেমিকাকে আটক করা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্রেমিকা স্বীকার করেছেন, ফেসবুকে রাশেদুজ্জামানের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে ছয় মাস একসঙ্গে ছিলেন তারা। এর মধ্যেই দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি  তৈরি হয়। সকালে প্রেমিকা ঘরের ভিতর থেকে প্রেমিকের সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকেন। প্রতিবেশী ও বাড়ির মালিক এসে দরজা ভেঙে রাশেদুজ্জামানের ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান। স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়ে আর ফেরেনি মেয়েটি। নিখোঁজ হওয়ার আগে মায়ের মোবাইল ফোনে রাতভর কী কী সব করত! তখনো পাত্তা না দিলেও উধাও হওয়ার পর ওই ঘটনাকেই বড় করে দেখছে মেয়েটির পরিবার। মাত্র ১৪ বছরের আদরের মেয়েকে উদ্ধারে থানায় অভিযোগ, র‌্যাবকে জানানোসহ সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে পরিবার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। র‌্যাব মেয়েটির মোবাইল ট্র্যাক করে যে তথ্য পেয়েছে তার সবটাই ভুয়া। পরিবারের ধারণা, মেয়ে কোনো খারাপ চক্রে পড়েছে। দায়িত্ব দেওয়া হলো ডিবি পুলিশের ওপর। মাত্র তিন দিনের মধ্যে ডিবি মেয়েটি এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্যক্তির অবস্থান ট্র্যাক করে ফেলল। প্রাপ্ত তথ্যগুলো জানিয়ে দিল দিনাজপুরের র‌্যাব-১৩-কে। কেননা শুরু থেকেই মামলাটি নিয়ে তারা কাজ করছিল। এরপর দিনাজপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া র‌্যাবের যৌথ অভিযানে শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়েছে বাঞ্ছারামপুর থেকে। গ্রেফতার করা হয়েছে ছেলেটিকেও।

পুরো ঘটনা জেনে পুলিশ হতবাক। মায়ের মোবাইল ফোন ব্যবহার করত মেয়েটি। স্কুলের বান্ধবীরা তাতে খুলে দিয়েছিল ফেসবুক। ব্যস! কয়েক দিনের মধ্যেই সাইদুল নামে এক ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায়। পরিচয়ের একুশ দিনের মাথায় ছেলেটি আসে দিনাজপুরে। ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে চা খায় মেয়েটি। তারপর আর কিছু মনে নেই। প্রথমে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়। বোঝানো হয় বাড়ি ফিরে গেলে বাবা-মা বকবে। বিয়ে করে সংসার করবে তারপর সৌদি আরব যাবে বলেও জানায় ছেলেটি। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে এসে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থাকতে শুরু করে। এই দুই মাসে বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়নি তাকে। মেয়েটির পাসপোর্ট তৈরির কাজও শুরু করেছিল ছেলেটি। মামলার তদন্তকর্তারা ধারণা করছেন, এরা শক্তিশালী কোনো পাচারকারী চক্র। যারা কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। তারপর বিয়ে করে সৌদি আরবে নিয়ে বিক্রি করে ধনকুবেরদের কাছে। মেয়ে জোগাড়ের এ কাজে ইদানীং ফেসবুক ও মোবাইল খুব ব্যবহূত হচ্ছে। অল্পের জন্য রক্ষা পেল মেয়েটি! শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, হাতে ফোন পেয়ে ফেসবুক ব্যবহারে এভাবে প্রেমে পড়ে কেউ পড়ছেন পাচারকারী চক্রের হাতে, কেউ হয়তো মামলার আসামি অথবা জীবনটাই হারাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফোন পেয়ে মেয়েটি কী করছে, কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, কী দেখছে রাতভর, তার কি খোঁজ রাখছেন কেউ? স্মার্টফোনে ফেসবুক, স্কাইপি কিংবা টিন্ডারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বুঁদ হয়ে থাকছে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা। হুট করে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রেমের ফাঁদে। আদান-প্রদান করছে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও। সেই ছবি বা ভিডিও একদিন ভাইরাল হচ্ছে। জীবন শুরুর আগেই শেষ দেখছে অনেকে! দিনাজপুরের মেয়েটির মতো আবেগের বশে একদিন পাড়ি দিচ্ছে অজানায়; যার শেষ পরিণতি হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো বন্দীশালা! সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রযুক্তির প্রভাব এবং এর ব্যবহার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার যেমন চায় না তেমনি জনগণও প্রযুক্তিকে এড়িয়ে নীরব থাকতে পারে না। সেটি কোনো সমাধানও নয়। তাই প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে হবে। তবে আমাদের মূল স্পিড হচ্ছে প্রযুক্তির ইতিবাচক, গঠনমূলক ও উন্নয়নের দিকগুলো। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যখন আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারব, তখন আমাদের রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের রাষ্ট্রে এটির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। কত বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোন ব্যবহার কারতে পারবে, সে বিষয়েও কিছু বলা নেই। নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে বয়সের একটা প্রভাব আছে। স্কুল-কলেজে যাওয়া শিক্ষার্থীদের যতই নৈতিকতা শেখানো হোক, নিষেধ করা হোক; সামনে কোনো উপকরণ থাকলে সেটা তারা ব্যবহার করবেই।’ ‘অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ না করা পর্যন্ত তাদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। সেক্ষেত্রে আমরা তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে পারি’— মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এখন আমরা শুধু একমুখী ফেসবুক ব্যবহার করছি এবং এর মাধ্যমে নানা ধরনের প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। অপ্রত্যাশিত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কিশোর-কিশোরীরা সংযত আচরণ করছে না। মানুষে মানুষে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। যখন ব্যবধান তৈরি হবে, তখন সামাজিক বিকাশ, সামাজিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবে এখন আমরা শিক্ষাটাও যথাযথভাবে দিতে পারছি না। শিক্ষার্থীরা দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুকে ব্যস্ত থাকে। এর প্রভাবে তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হয়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর