মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিটিসিএল তুমি কার?

ভোগান্তির শেষ নেই গ্রাহকদের, ধারাবাহিক ক্ষতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি ইন্টারনেট সেবার বেহাল দশায় ফুলেফেঁপে উঠছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বিটিসিএল তুমি কার?

‘সংযুক্ত থাকুন...সর্বনিম্ন খরচে সব সময়—স্লোগানের মধ্য দিয়ে সেবার বার্তা দেয় বিটিসিএল। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? ছয় মাস ধরে দৌড়ঝাঁপ করে সংযোগ পেলাম। এখন মাসে তিনবার করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ছুটতে হয় বিটিসিএলের অফিসে। বারবার বলেও মেলে না সংযোগ। সে জায়গায় একই পরিমাণ অর্থ খরচ করে নিরবচ্ছিন্ন সেবা পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটের ব্রডব্যান্ড সংযোগে। তাহলে অযথা কেন ভোগান্তি পোহাব!’ এভাবে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সেবার মান নিয়ে অজস্র অভিযোগ করেন মীর আবদুল আলিম নামের এক গ্রাহক। বিটিসিএল সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহক ছড়িয়ে আছে। পর্যাপ্ত জনবল থাকলেও ক্রমেই কমছে গ্রাহকসংখ্যা। প্রতিবছর লাভের তো নয়ই, বরং ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। বিটিসিএলের টেলিফোন অপারেটর সক্ষমতা রয়েছে ১৩ লাখ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় সাত লাখ ১৬ হাজারে এবং ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে গ্রাহক ছয় লাখ ৬২ হাজারে নেমে আসে। অর্থাৎ এক বছরে গ্রাহক কমেছে ৫৪ হাজার। অথচ ২০১২ সালে গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৪৩ হাজার। গ্রাহকসংখ্যা কমে যাওয়ায় কমেছে রাজস্বও।

গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৮৩ কোটি ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৩১ টাকা। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৮ কোটি ৩৪ লাখ ২৬ হাজার ৭৫০ টাকা। অথচ ২০১১-১২ অর্থবছরে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬২ কোটি ৮৪ হাজার ৩৩৮ টাকা।

সেবার বিষয়ে বিটিসিএল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সরকারি এ সংস্থাটি গ্রাহকদের আট ধরনের সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে আছে—পিএসটিএন লাইসেন্স, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে সার্ভিস অপারেটর লাইসেন্স, ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ সার্ভিস অপারেটর লাইসেন্স, ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে সার্ভিস অপারেটর লাইসেন্স, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার লাইসেন্স, ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেবল লাইসেন্স, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক লাইসেন্স এবং ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস লাইসেন্স। অর্থাৎ নতুন ল্যান্ডফোনের সংযোগ দেওয়া, ব্রডব্যান্ড সংযোগ দিয়ে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা, অন্য অপারেটরে কল করার জন্য এক্সচেঞ্জ করা, অন্য অপারেটরদের ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে বিটিসিএল। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এসব সেবা খাতে পড়েছে ভাটা। এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। মোবাইলে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফিচার। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মোবাইল বহনযোগ্য কিন্তু ল্যান্ডফোন চাইলেই ঘরের বাইরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। মোবাইলে মেসেজ পাঠানো থেকে শুরু করে ছবি তোলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা সবই সম্ভব। কিন্তু ল্যান্ডফোনে কথা বলা ছাড়া আর কিছুই সম্ভব নয়। ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হলেও তা ওয়্যারলেস নয়। এ ছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ নিয়েও রয়েছে গ্রাহকদের অভিযোগ। একই সঙ্গে বিটিসিএলের ল্যান্ডলাইন ফোনের সঙ্গে মোবাইল অপারেটরে কল আসা-যাওয়ারও ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিটিসিএল থেকে মোবাইল অপারেটরে এক হাজার ৬৪৮ মিলিয়ন মিনিট কল যায়। আর মোবাইল অপারেটর থেকে আসে ১৭৩ মিলিয়ন মিনিট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোবাইল অপারেটর থেকে আসে ১৫৯ মিলিয়ন মিনিট আর যায় এক হাজার ৬৩১ মিনিট। বিটিসিএল থেকে বিটিসিএলের কলও এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৬২ মিলিয়ন মিনিট। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ কল ছিল ৪১২ মিলিয়ন মিনিট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ৩৫০ মিলিয়ন মিনিটে নেমে আসে। প্রতিবছরই প্রায় ৫০ হাজার করে কমে যাচ্ছে বিটিসিএলের গ্রাহক। আর এই বিপুলসংখ্যক গ্রাহক ধরতে উঠেপড়ে লেগেছে অন্য ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিটিসিএলের গ্রাহকদের সংযোগ প্রায় সময়ই বিচ্ছিন্ন থাকে। ফলে অর্থ খরচ করে সংযোগ নিলেও ব্যবহার করতে পারছেন না গ্রাহকরা। গ্রিন রোডের বাসিন্দা গোবিন্দ সাহা বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর আগে বিটিসিএলের সংযোগ নিয়েছি। কিন্তু প্রতি মাসে বিচ্ছিন্ন সংযোগ সংযোজনের জন্য তাদের টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরতে হয়। একদিন তাদেরই এক কর্মকর্তা বললেন, ‘‘এত না ঘুরে প্রাইভেট অপারেটরদের সেবা নিতে পারেন।’’ তারা আমাদের কাছে আসবে কি, আমাদেরই তাদের পেছনে ঘুরতে হয়। সামনের মাসে আমার বাড়ির সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করার আবেদন করব।’ শুধু এই গ্রাহক নন, এ রকম অসংখ্য গ্রাহকের অভিযোগে জর্জরিত বিটিসিএল। অথচ একই সেবা দিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে বেসরকারি ইন্টারনেট সংযোগদাতারা। বন্যার পানির মতো বাড়ছে এসব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। তারা সেবা দিতে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে। একবার ফোন করলেই সমস্যা সমাধানে হাজির হচ্ছেন তাদের কর্মীরা। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কথা বলা এবং ইন্টারনেট সেবা দিয়ে বাজার দখল করলেও বিটিসিএলের সেবা এবং আয়ে ভাটার টান। এ ব্যাপারে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর