বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র জীবনের সাহিত্যচর্চায় শিলাইদহ এক সোনালি অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর জীবনের সোনালি সময়গুলো কেটেছে এখানেই। কলকাতার কংক্রিটের দেয়ালে বন্দী রবীন্দ্রনাথ এখানে মুক্তবিহঙ্গের মতো ডানা মেলে ছিলেন। তাই অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শিলাইদহে বসে এক পত্রে তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কি আশ্চর্য সুন্দরী— কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়।’ যে গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য কবি নোবেল পেয়েছিলেন, সেই কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই তিনি রচনা করেছিলেন পদ্মাচুম্বিত শিলাইদহে বসে। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ২০ মিনিটের পথ এই শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। প্রাচীন শহর কুমারখালী উপজেলায় পদ্মা নদীর কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এ কবিতীর্থ। ৯.৯৩ একর জমির ওপর এর অবস্থান। শুক্রবার বাদে প্রতিদিন এ কুঠিবাড়ী দর্শনার্থীর জন্য খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। প্রতি বছর ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে এ কুঠিবাড়ীতে তিন দিনের উৎসব হয়। আর ২৫ বৈশাখ এলেই হাজারো দর্শনার্থী ও ভক্ত রবীন্দ্রনাথের সেসব দিনের স্মৃতি হাতড়াতে ছুটে আসেন এ কুঠিবাড়ীতে। বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৮৯১ সাল থেকে ১০ বছর এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এর মধ্যে দুই বছর তিনি সস্ত্রীক এ কুঠিবাড়ীতে বসবাস করেছেন। পল্লী উন্নয়নে, পল্লীর যুবকদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য তিনিই প্রথম এ অঞ্চলে গোল আলুর চাষ শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত ধানবীজ এনে কৃষকের মাঝে বিতরণ, গুটিপোকার চাষ ও কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে কৃষকের দারিদ্র্য ঘোচানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। জমিদারি পরিচালনা, সংস্কারমূলক কাজের পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। পদ্মা, গড়াই, শিলাইদহের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা— সবকিছুতেই খুঁজে পেয়েছিলেন লেখার উৎস। তিনি ১১টি কাব্যগ্রন্থসহ ৬০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এখানে বসেই। ১৯৪০ সালের মার্চের মৃত্যুর বছরাধিককাল আগে রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য শিলাইদহে যে নিখিলবঙ্গ পল্লীসাহিত্য সম্মেলন হয় তাতে পল্লীপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ এক বাণীতে বলেছিলেন, ‘আমার যৌবনের ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্য-রস-সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ পল্লীতে। সেখানে আমার যাত্রাপথ আজ আর সহজগম্য নয়। কিন্তু সেই পল্লীর স্নিগ্ধ আমন্ত্রণ সরস হয়ে আছে আজও আমার নিভৃত স্মৃতিলোকে, সেই আমন্ত্রণের প্রত্যুত্তর অশ্রুতিগম্য করুণ ধ্বনিতে আজও আমার মনে গুঞ্জরিত হয়ে উঠেছে।’
শিলাইদহ জীবনে বাউল ও বাউল দর্শনও রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের মনে বাউল চেতনা সঞ্চারের উৎস ছিল লালন ফকির ও গগন হরকরা। আর গগন হরকরার (আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে— হারায়ে সেই মানুষে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।) সুরেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’; যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। প্রতি বছরের মতো এবারও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এখানে আজ থেকে তিন দিনের ১৫৭তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে কুঠিবাড়ীকে।