রবিবার, ১৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঢাকা চেম্বারের প্রাক-বাজেট

কর ছাড়ের কথা দিলেন অর্থমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

আসছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বেশ কিছু খাতে কর ছাড় দেওয়ার কথা ব্যবসায়ীদের কাছে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি তরুণদের ওপর বিশ্বাস রেখে করপোরেট কর কমানোর অঙ্গীকার করে বলেছেন, দ্বৈত কর নিয়ে সিদ্ধান্ত আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। অর্থমন্ত্রীর কাছে ১৬টি অগ্রাধিকারমূলক প্রস্তাব তুলে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিল্প ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বাণিজ্য, মাল্টিপল কর প্রত্যাহার, করপোরেট কর কমানো, প্রবাসী পেশাজীবীদের কর থেকে অব্যাহতি, বিনিয়োগ, আর্থিক খাত ও পুঁজিবাজার উন্নয়নে আগামী বাজেটে দিকনির্দেশনা প্রয়োজন।

গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই), সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের যৌথভাবে আয়োজিত প্রাক-বাজেট মতবিনিময় সভায় উঠে আসে এসব বিষয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সঞ্চালনায় সভায় প্যানেল আলোচক ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান। এই প্রাক-বাজেট সভায় ডিসিসিআইর সাবেক দুই সভাপতি হোসেন খালেদ ও আসিফ ইব্রাহিম দুটি করে মোট চারটি সেশনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এর ওপর প্রতিটি সেশনে চারজন করে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন। মতবিনিময় সভায় চারটি সেশনে বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘তরুণদের ওপর বিশ্বাস রেখে এবার বাজেটে করপোরেট করহার কমানো হচ্ছে। কারণ খেয়াল করেছি, বিপুলসংখ্যক তরুণ এখন কর দিতে আগ্রহী।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে দেশে দুই স্তরের ভ্যাট চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনতে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) ওয়ানস্টপ সেবা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দেওয়ার সাত মাসের মধ্যে বিনিয়োগ সহায়তা প্রদান করা হবে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের বিষয়টি বাজেট ঘোষণার পর পর্যালোচনা করা হবে। দেশের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষম প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘কমপিটিশন অ্যাক্ট’ জরুরি। সরকারি ২৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুঁজিবাজারে না আসতে পারার বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক বলে অভিমত দেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে ধীরগতি এবং উন্নয়নকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই তা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে সরকারের টাকার অপচয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।

অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার সংবাদপত্র শিল্পে ব্যবহূত নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি তুলে ধরে বলেন, গত এক বছরে সংবাদপত্রে ব্যবহূত নিউজপ্রিন্টের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। সংবাদপত্র শিল্প রক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহার প্রয়োজন বলে মত দেন দেশের প্রবীণ এই সাংবাদিক।

এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব একটি বাজেট দেওয়ার চেষ্টা করব। আগামী বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে। আমদানি কর এলএনজির দাম যেন সহনীয় মাত্রায় থাকে, সে বিষয়ে সরকার সচেতন।’

ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, আগামী বাজেটে করনীতিমালার সহজীকরণসহ অন্যান্য নীতিমালার সংস্কার, বিদ্যমান করহার কমানো, ট্যাক্স কার্ড প্রদান, ব্যবসায় ব্যয় কমানো, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পদক্ষেপ, যোগাযোগ অবকাঠামোর আধুনিকায়ন জরুরিভাবে প্রয়োজন।

প্রাক-বাজেট মতবিনিময় সভায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, করপোরেট কর যৌক্তিক হারে পর্যায়ক্রমিকভাবে কমানো প্রয়োজন। করের হার কমানোর ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণের ওপর যেন কোনো অভিঘাত না আসে, সেদিকে যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, সরকারকে এলএনজির দাম সহনীয় মাত্রায় নির্ধারণ করতে হবে। দেশীয় কয়লার ব্যবহার বাড়াতে হবে। নতুন নতুন গ্যাসকূপ খননের কার্যক্রম বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শও দেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ফলে নতুন শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তারা জমি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা নিরসন করতে হবে। প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহের সঙ্গে স্থল, নৌ ও সামুদ্রিক বন্দরগুলোর যোগাযোগ স্থাপনের ওপর জোর দেন তিনি।

প্রাইস ওয়াটার কুপার্স (পিডব্লিউসি) বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ বলেন, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের ওপর করের পাশাপাশি অন্যান্য কর প্রদানের ফলে উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। এটা নিরসন জরুরি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় ভ্যাট আইন সংস্কারে গতি সঞ্চার করা প্রয়োজন। গত সাত বছরে জিপিডিতে রাজস্বের অবদান আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পায়নি, এটা উদ্বেগের বিষয়।

গ্রামীণফোন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাইকেল প্যাটরিক ফোলে বলেন, দেশের মোবাইল প্রযুক্তি খাতে ফোর জির ব্যবহার আরও সম্প্রসারণের জন্য নীতি সহায়তা প্রদান করা হোক।

ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ফিকি) সাবেক সভাপতি ও বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ কেন দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে না, তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রণোদনা প্রদান করা হয়, যা বাংলাদেশেও চালু করা প্রয়োজন।’

আইডিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার খুবই বেশি। এর কারণে আশানুরূপ হারে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন হচ্ছে না।

মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ, আসিফ ইব্রাহিম ও মতিউর রহমান, ফিকি সভাপতি শেহজাদ মুনিম, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি আদিব এইচ হাসান, ডিসিসিআইর ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি কামরুল ইসলাম, সহ-সভাপতি রিয়াদ হোসেন, সাবেক সহ-সভাপতি হুমায়ুন রশিদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. মাশরুর রিয়াজ প্রমুখ।

সভায় ডিসিসিআই তাদের বাজেট প্রস্তাবে সব ধরনের আয়কর হার ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, সব ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা নির্ধারণ করা হোক। সব ধরনের করপোরেট করহার ৫ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়ে ডিসিসিআই বলেছে, করপোরেট কর রাজস্ব আয়ের বড় খাত। তাই সব ধরনের করপোরেট করহার ৫ শতাংশ কমানো হোক। এতে ব্যাংকের ওপর চাপ কমবে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে অবকাঠামো খুবই জরুরি উল্লেখ করে বলা হয়, আগামী বাজেটে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল সময়কে অবকাঠামো বর্ষ ঘোষণা করা হোক। বিদেশি বিনিয়োগ না আসার পেছনে অবকাঠামো সংকট অনেকটা দায়ী। এখন আধুনিক অবকাঠামো করতে পারলে বিনিয়োগ আসবে। আঞ্চলিকভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলা খুবই জরুরি। সব মিলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক করা গেলে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বাড়বে।

ডিসিসিআইর প্রস্তাবে আরও বলা হয়, উন্নত বিশ্বে যেসব বাংলাদেশি দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে আগামী পাঁচ বছর কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হোক। কারণ প্রতি বছর প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশি শ্রমিকরা বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স হিসেবে নিয়ে যাচ্ছেন। ল্যাপটপের মতো ২৫ হাজার টাকা দামের স্মার্টফোনে কর সুবিধা দেওয়া হোক।

সর্বশেষ খবর