রবিবার, ১৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
আজ বিশ্ব মা দিবস

তারা মা হচ্ছে পুতুল খেলার বয়সেই

জিন্নাতুন নূর

তারা মা হচ্ছে পুতুল খেলার বয়সেই

ময়মনসিংহ থেকে মিরপুরের রূপনগরের দুয়ারীপাড়া বস্তির একটি খুপরি ঘরে মা-বাবার সঙ্গে বছরখানেক আগে এসে উঠেছিল সীমা (১৪) ও রীমা (১২) নামের দুই বোন। এই দুই কিশোরীর রিকশাচালক বাবা আবদুল খালেক ও গৃহকর্মী মা আয়শা আক্তার সামর্থ্য না থাকায় মেয়েদের ঘরের কাছের এক মাদ্রাসায় পাঠাতেন। কিন্তু মাদ্রাসায় আসা-যাওয়ার পথে সীমা-রীমা প্রায়ই এলাকার বখাটেদের উত্ত্যক্ততার শিকার হতো। ফলে মেয়েদের মাদ্রাসায় যাওয়া বন্ধ করে দেন আবদুল খালেক। এমনকি প্রতিবেশীদের পরামর্শে মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে সীমার চেয়ে বয়সে দ্বিগুণ বড় এক বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেন। অবশ্য মেয়ের বিয়ের জন্য সীমার মা-বাবাকে কোনো অর্থ খরচ করতে হয়নি, উল্টো সীমার মা-বাবাকেই নগদ দশ হাজার টাকা দেন সীমার স্বামী। বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই সীমা অপুষ্ট এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। সন্তান প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য প্রচণ্ড অসুখ থেকে সেবার কোনোরকমে জীবন ফিরে পায় সীমা। তবে কিছুটা সুস্থ হলে মায়ের কাছে সন্তানকে রেখেই গার্মেন্ট কারখানায় কাজ নেয় কিশোরীটি। আবার পরের বছরেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে সীমার গর্ভে সন্তান আসে। এবারও সন্তান জন্মের আগেই সীমার শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয় সন্তানটিকে নিজের কাছে রাখতে ভয় পায় কিশোরীটি। যে হাসপাতালে তার সন্তান জন্ম হয় সেখানকার এক নার্স এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে ১০ হাজার টাকায় সীমার নবজাতক শিশুটি বিক্রি করে দেয়। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে গর্ভের সন্তানকে কাছে না পেয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে কিশোরীটি। বুকের ধনকে নিজের কাছে ফিরে পেতে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। অবশেষে এক সপ্তাহ পর সন্তানকে কাছে পেয়ে মুখে হাসি ফুটে এই কিশোরী মায়ের। এ পরিস্থিতিও আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মা দিবস।

আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে সীমার বিয়ের পর এবার রীমার জন্যও পাত্র দেখতে শুরু করেছেন এই কিশোরীদের অভিভাবক। তারা জানান, সীমার বিয়ের সময় কাবিননামায় মেয়ের বয়স ১৮ লিখেছিলেন। এবার দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রেও তারা একই পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবছেন। তাদের যুক্তি মেয়েকে দিয়ে যেহেতু আয় হবে না। আবার ঘরে থাকলেও বখাটেদের উৎপাত, এ জন্য তাদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দায় সারতে চান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, বস্তিতে বসবাসকারী ৮০ ভাগ কন্যা শিশুই বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। আর এমনটি হচ্ছে দারিদ্র্য, কুসংস্কার, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, যৌন হয়রানি, কন্যা শিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে। আবার রাজধানীর বস্তিগুলোতে বসবাসকারী দরিদ্র পরিবারের কন্যা শিশুদের বেশিরভাগ অভিভাবকদের ভাবনাই সীমার মা-বাবার মতো। মেয়ে একটু বড় হলেই তাকে বিয়ে দিয়ে যেন ঘাড় থেকে ‘বোঝা’ নামান। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ের কারণে এসব কন্যা শিশু বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সমস্যার শিকার হয়। যে বয়সে তাদের পুতুল খেলার কথা সে বয়সে তারা সন্তান প্রতিপালনের মতো গুরু দায়িত্ব পালন করে। ফলে শিশুকালেই রঙিন শৈশব ফিকে হয়ে আসে এই কন্যা শিশুদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) স্ত্রী ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. পারভীন আক্তার শামসুন্নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার কন্যাশিশুদের শারীরিক বিকাশ ভালোভাবে হয় না।

 আগাম সন্তান জন্মদানে মা ও সন্তান উভয়ের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রসবে জটিলতা তৈরি হলে মা ও সন্তান উভয়ের মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হয়।

বাল্যবিবাহের শিকার কন্যাশিশুদের ওপর ইনিশিয়েটিভ ফর ম্যারেজ অ্যাডলোসেন্ট গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট (ইমেজ) এর এক জরিপে দেখা যায়, গ্রাম ও প্রত্যন্ত এলাকাতে কিশোরীদের মাসিক হলেই ধরে নেওয়া হয় যে, মেয়েটি গর্ভধারণে সক্ষম হয়েছে, অতএব এবার তাকে বিয়ে দিতে হবে। আবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের অপর এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বস্তিতে বাসকারী কন্যা শিশুরা ভালো পাত্র পেয়েছে এমন ধারণার কারণে ৫২ ভাগ, দারিদ্র্যের কারণে ২০ ভাগ এবং যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে ১৯ ভাগ বাল্যবিয়ের শিকার হয়।

তবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, সরকার বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর। এ জন্য মন্ত্রণালয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারের ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর