রবিবার, ২০ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছোট ভুল বড় খেসারত

মির্জা মেহেদী তমাল

ছোট ভুল বড় খেসারত

রাজধানীতে ক্রমেই প্রতারণার মাধ্যমে অপরাধ বাড়ছে। এ   ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ফেসবুক,  মোবাইল ফোন, ই-মেইলসহ নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে প্রতারণার ফাঁদ বিস্তার করছে। এ ফাঁদ থেকে বাদ যাচ্ছেন না শিল্পপতি, এমপি, ইউপি চেয়ারম্যান, পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। তবে এসব দুর্বৃত্তকে ধরতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) শিক্ষামন্ত্রীর পিএস পরিচয়ে ফোন দেয় এক ব্যক্তি। ওই ব্যক্তি ফোনে বলেন, আপনার উপজেলার এক বাসিন্দা ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তার ক্লিনিক খরচসহ অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বাবদ ২০ হাজার টাকা লেগেছে। আপনি দয়া করে যদি আমাকে টাকাটা বিকাশ করে দিতেন উপকার হতো। লোকটির এ কথায় বিশ্বাস করে ওই ইউএনও পাঠিয়ে দিলেন ২০ হাজার টাকা। এরপর তিনি ওই গ্রামে খোঁজ নিয়ে দেখেন  কেউ মারা যায়নি। পরে ইউএনও ফোন করে দুর্বৃত্তের ব্যবহূত ওই নম্বরটা বন্ধ পান। প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছে  ফোন আসে। বন্ধু পরিচয়ে ভীষণ অসুস্থতার কথা বলে ১০ হাজার টাকা বিকাশ করতে বলেন। আর এতে বিশ্বাস করে ওই কর্মকর্তা পাঠিয়ে দিলেন ১০ হাজার টাকা। দুর্বৃত্ত টাকা পাওয়ার পর আবার ওই কর্মকর্তাকে ফোন দেন। বলেন, দোস্ত আরও ১০ হাজার টাকা দিলেই আমার পরিপূর্ণ চিকিৎসা হয়ে যাবে। তাহলে আর কারও কাছে ধার করতে হবে না। এবারও সরল বিশ্বাসে আরও ১০ হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠিয়ে দিলেন ওই কর্মকর্তা। বিষয়টি হঠাৎ তার সন্দেহ হলে অন্য বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারেন, ওই বন্ধু সুস্থ ও ভালো আছেন। পরে ওই দুর্বৃত্তের মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পান। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সুন্দরী ও স্মার্ট এক মেয়ে এক ছেলেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। ছেলেটা রিসিভ করতেই হায়-হ্যালো শুরু করে মেয়েটি। এরপর মোবাইল নম্বর দেওয়া-নেওয়া। এবার ফেসবুক ছেড়ে মোবাইল ফোনে দিন-রাত কথোপকথন। এক পর্যায়ে মেয়েটা জানতে পারেন ছেলেটা ধনাঢ্য ব্যক্তি। পরে পরিকল্পনা করে ছেলের সঙ্গে  দেখা করেন। এরপর ওই ছেলেকে জিম্মি করা হয়। ছেলেটি জানতে পারেন তিনি প্রতারকদের কবলে পড়েছেন। পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছেলেটাকে ছেড়ে দেন দুর্বৃত্তরা। অজ্ঞাত এক ব্যক্তি এক ইউপি চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোনে  ফ্লেক্সিলোড করে ২০০ টাকা পাঠান। পরে ওই ব্যক্তি ফোন করে চেয়ারম্যানকে বলেন, ভাই! ভুলক্রমে আপনার মোবাইলে ২০০ টাকা চলে গেছে। টাকাটা ফেরত দিলে আমার উপকার হবে।’ এরপর চেয়ারম্যান টাকা ফেরত দেন। পুনরায় ৩০০ টাকা পাঠিয়ে একইভাবে ফেরত নেওয়া হয়। টাকা ফেরত নিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি চেয়ারম্যানের প্রশংসা করে তার বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। এভাবে মোবাইলে কথাবার্তার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় এলে তাকে জিম্মি করেন। এরপর তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন প্রতারকরা। জিনের বাদশাহ পরিচয়ধারী প্রতারকরা মোবাইলে ফোন দিয়ে প্রথমে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত শোনান। এরপর বিভিন্ন মাজারের অজুহাত দেখিয়ে আপনার কাছ থেকে হাদিয়া চাওয়া হবে। একই সঙ্গে বলা হবে আপনি  সৌভাগ্যবান বলেই আপনাকে ফোন দেওয়া হয়েছে। আপনি টাকা না দিলে আপনার নানা সমস্যা হতে পারে। আর এ চক্রটি সাধারণত গভীর রাতে ফোন দিয়ে থাকে। মোবাইল  ফোনে প্রেমের ফাঁদে পড়ে অনেকেই নিঃস্ব হচ্ছেন। এ চক্রটি মানুষকে ফাঁদে ফেলার জন্য মধুর কণ্ঠি নারীদের ব্যবহার করে। এদের মূল টার্গেট ভালো চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী। চক্রের সদস্যরা প্রথমে শহরের নামি-দামি ব্যবসায়ীদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। এরপর পরিকল্পনার ছক অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি প্রতারণার জাল পাতেন। প্রাথমিকভাবে এ চক্রের নারী সদস্যরা প্রথমে কাঙ্ক্ষিত নম্বরে মিস কল দেন। সাড়া পেলেই কথা বলা শুরু। মিস কলে কাজ না হলে ফোন দেন। এরপর তারা ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিভিন্ন নামি-দামি হোটেলে খাওয়া-দাওয়ার অভিলাষও প্রকাশ পায়। এরপর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি কৌশলে নারী সদস্যরা মোবাইলে ধারণ করে রাখেন। পরে তা ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। অনেক নারী প্রতারক আবার বিয়েও করে ফেলেন। কিছুদিন সংসার করে সর্বস্ব লুটে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। ই-মেইল প্রতারকরা প্রথমে বিভিন্ন ব্যক্তির ই-মেইল আইডি সংগ্রহ করেন। পরে তাদের কাছে বিদেশে দুর্ঘটনা বা নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনী ব্যক্ত করে মেসেজ পাঠিয়ে অনুদান চান। সেখানে দুর্ঘটনা বা নিঃস্ব হওয়ার বিস্তারিত সব বর্ণনা করা হয়। বলা হয় দেশে এলে সব টাকা পরিশোধ করা হবে। পাঠানো ই-মেইলে টাকা পাঠানোর পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও দেওয়া থাকে। মোবাইল ফোনে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে মফস্বল, উপজেলা ও  জেলা শহরগুলোয়। সরল সহজ অথবা অশিক্ষিত নারী ও কিছুটা অসচেতন মানুষ এদের খপ্পরে পড়ে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ক্ষতির শিকার হলেও প্রতিকার  পেয়েছেন এমন খবর জানা যায়নি। পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, ‘মোবাইলসহ প্রযুক্তিগত প্রতারণার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই। প্রতারকরা বহুমাত্রিক ও বিভিন্ন ধরনের ক্রাইম করছে। আমরা প্রতারক চক্রকে ধরতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করি। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ এ বিষয়ে স্পেশাল মনিটরিং করছে। ইতিমধ্যে আমরা বেশকিছু প্রতারককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর