মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিপজ্জনক শান্তিরক্ষা মিশন মালিতে শান্তির খোঁজ

শিমুল মাহমুদ, মালি থেকে

এক সময়ের সমৃদ্ধ দেশ পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনা, বিমান ও পুলিশ বাহিনীর ১৩ হাজার ৫৬১ জন সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত। অপারেশনে বেরিয়ে অক্ষত অবস্থায় ক্যাম্পে ফেরা যাবে কিনা সেই অনিশ্চয়তা তাদের প্রতিক্ষণের। জাতিসংঘ নিজেই এখন এটিকে বলছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল শান্তিরক্ষা মিশন। কিন্তু দেশটির রাজধানী বামাকোতে ঘুরে কারও বোঝার উপায় নেই দেশটির একটি বড় অংশজুড়ে মৃত্যুফাঁদ পাতা রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে উত্তর মালির মরুভূমিতে জিহাদিদের পুঁতে রাখা আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সক্লুসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণে যখন ৪ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন, তখন রাজধানী বামাকোর জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে স্থাপিত শান্তিরক্ষায় নিহতদের স্মৃতিফলকে নামের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৫ জনে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর প্রাণ গেছে ১৩ জনের। কিন্তু দেশটির রাজধানী দেখে বোঝার উপায় নেই নগরীর বাইরে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি চলছে। রাজধানী বামাকোর পুরোটাই সবুজে ঘেরা। যত দূর চোখ যায় শুধু নিমগাছের ছড়াছড়ি। দিনের তাপমাত্রা থাকে ৪০-৫০ ডিগ্রির মধ্যে। এই রুক্ষ, বৈরী আবহাওয়ায় নিমগাছ চমৎকার মানিয়ে নিতে পারে বলেই পরিকল্পিতভাবে নিমগাছ লাগানো হয়েছে। ফলে শহর হয়ে উঠেছে সবুজ। আফ্রিকার অষ্টম বৃহত্তম এই দেশটির উত্তরে প্রায় অর্ধেকজুড়ে সাহারা মরুভূমি। দেশটির দক্ষিণে নাইজার ও সেনেগাল নদী। কৃষিভিত্তিক দেশটিতে মাছ ধরা নাগরিকদের জীবিকার অন্যতম অবলম্বন। দেশটির অর্ধেকেরও বেশি নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। মালি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। খনি থেকে সোনা উত্তোলনে আফ্রিকায় তৃতীয় বৃহত্তম দেশ মালি। ১৮৯৫ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এটি ছিল ফরাসিদের উপনিবেশ। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা পেলেও ১৯৯১ সাল পর্যন্ত স্বৈরশাসকের অধীনে ছিল দেশটি। ১৯৯২ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়। মালির ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ২০১১ সাল থেকে দেশের উত্তর প্রান্তে তুয়ারেগ জাতিগোষ্ঠী উন্নয়ন উপেক্ষার অভিযোগ তুলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনে সরকারি ব্যর্থতার অভিযোগে কিছু সেনা মিলে ২০১২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আমাদো টোরেকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করে। পরে অবশ্য বেসামরিক শাসন পুনর্বহাল হয়। দুর্বল সরকারি প্রশাসনসহ নানা অস্থিরতার কারণে মালিতে জঙ্গি তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে মালি ও ফরাসি সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে তা দমন করা হয়। এরপর সরকার জাতিসংঘের সহায়তা চাইলে এখানে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হয়। বাইরে থেকে অনেক ভয় আর আতঙ্কের গল্প শুনে মালিকে যতটা ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিল রাজধানী বামাকো ঘুরে সে আতঙ্ক কেটে যায়। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, বিলাসবহুল আন্তর্জাতিক রুটের বাস শহরটিকে আকর্ষণের কেন্দ্রে রূপান্তর করেছে। বাসে করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যাওয়া যায়। শহরজুড়ে অসংখ্য গাধার গাড়ি চোখে পড়ল। শহরতলি কিংবা গ্রামের দিকে এদের সংখ্যা অনেক বেশি। গাধা বিপুল পরিমাণ মাল টানছে। আবার নিজের কাঁধে চালককে বসতেও দিচ্ছে। দেখলেই গল্পের গাধার কথা মনে পড়ে যায়। বাংলাদেশের প্রায় ৯ গুণ বড় মালির আয়তন, ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৮৩৯ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। মানুষের গড় আয়ু এবং সাক্ষরতার হার এখানে বিপজ্জনকভাবে কম। প্রত্যেক বিবাহিত নারীর গড় সন্তান সংখ্যা ৬ দশমিক ৫ জন। গড় আয়ু ৫৩.০৬ বছর। দারিদ্র্য সত্ত্বেও পুরুষরা ফুলবাবুর মতো আয়েশী অলস জীবন-যাপন করে। কর্মঠ নারীরা সন্তান, সংসার সামলে বাইরে আয়-রোজগারেও ভূমিকা রাখে। নারীরাই মালির প্রাণশক্তির উৎস। শহরের অন্তত ৪০ ভাগ মোটরসাইকেল চালক মহিলা। ব্যবসা বাণিজ্যে মেয়েদের আধিপত্য। সরকারের প্রায় অস্তিত্বহীন উত্তর মালির মরু জনপদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের হাত ধরে বন্ধ হয়ে যাবে, মালি হয়ে উঠবে এক আকর্ষণীয় শান্তিময় জনপদ, সে আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মালিয়ান নাগরিকের।

সর্বশেষ খবর