বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঈদ সামনে রেখে বেপরোয়া অজ্ঞান-মলম পার্টি

আলী আজম

রাজধানীতে ঈদ সামনে রেখে অজ্ঞান-মলম পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। বাস-লঞ্চ-ট্রেন টার্মিনালসহ জনাকীর্ণ স্থানে হকার সেজে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করছে তারা। আর এসব খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে চেতনানাশক ওষুধ। ফলে এগুলো ক্রয় করে কেউ খেলেই  মাশুল দিতে হচ্ছে। কখনো কখনো চেতনানাশক ওষুধের মাত্রা বেশি পড়ায় ভিকটিম মারা যাচ্ছে। কেউবা স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতেই পারছে না। ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। একের পর এক তালিকা করেও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হাতে গোনা কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে। বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪০টি পয়েন্টে অজ্ঞান পার্টির শতাধিক গ্রুপ সক্রিয়। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সহজ-সরল মানুষকে লক্ষ্য করে ফেরিওয়ালা সেজে জুস, ডাবের পানি, খেজুর, ঝাল মুড়ি, শরবতসহ নানা

উপকরণ বিক্রি করছে। আর প্রতারিত মানুষ সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি জীবন হারানোর মতো ঝুঁকিতে পড়ছেন। প্রতিদিন গড়ে ১০ জন মানুষ অজ্ঞান ও মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি নিয়মিত অভিযান চালিয়ে তারা অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেফতার করছে বলেও দাবি করেছে। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, রোজা ও ঈদকে টার্গেট করে ১০/১২টি অজ্ঞান ও মলম পার্টির চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের সদস্য সংখ্যা অন্তত ১০০। তারা যাত্রী ও হকার বেশে যাত্রীদের অজ্ঞান করে সবকিছু হাতিয়ে নেয়। গতকাল রোজার ৬ষ্ঠ দিনে কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান ও মলম পার্টির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন— কামাল হোসেন, মাহবুব মুন্সি, জুয়েল, মাসুম মিয়া, মিঠু মিয়া, আলম, রাকিব, আতাউর রহমান আক্তার, সবুজ, মুক্তার হোসেন, সুমন ও নাজমুল। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪৮২ পিস চেতনানাশক ট্যাবলেট, ১৩ কৌটা বিষাক্ত মলম ও ৬ বোতল বিষমিশ্রিত পানীয় উদ্ধার করা হয়। ডিবি (পশ্চিম) বিভাগ সূত্র বলছে, গ্রেফতারকৃতরা ঢাকা-গাজীপুর রোডের বিভিন্ন পরিবহনে উঠে যাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করত। এরপর কৌশলে তাদের চেতনানাশক ট্যাবলেটমিশ্রিত পানীয় পান করাত। কখনো তাদের চোখে বিষাক্ত মলম লাগিয়ে দিত। যাত্রীরা অজ্ঞান হয়ে গেলে সুযোগ বুঝে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করত। এমনকি তারা বিভিন্ন চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষের চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক ট্যাবলেট মিশিয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছরই ঈদকে টার্গেট করে রমজানের শুরুতেই তৎপর হয়ে ওঠে অজ্ঞান ও মলম পার্টি। তারা নানা ছদ্মবেশে বাস- ট্রেন-লঞ্চ এবং জনসমাগমপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে। সাধারণ ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে মিশে তারা ইফতার সামগ্রীসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে। যাত্রীদের মধ্যে তারা সাধারণত টার্গেটকৃত ব্যক্তির কাছে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো খাবার বিক্রি করে। এসব খাবার খেয়ে অচেতন হয়ে পড়লে চক্রের সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তির সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে। রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, সদরঘাট, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও কমলাপুর রেলস্টেশনে এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। তারা সাধারণত তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করে। একটি গ্রুপ ফেরি করে খাবার বিক্রি করে। আরেক গ্রুপ উদ্ধারকর্মী হিসেবে আশপাশেই ঘোরাঘুরি করে। তৃতীয় গ্রুপ রিকশা বা সিএনজি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসে থাকে। টার্গেট ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে পরিচিত সহযাত্রী অথবা কাছের আত্মীয় হিসেবে দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যরা এগিয়ে যায়। অচেতন ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার নাম করে তারা নিজেদের (তৃতীয় গ্রুপ) যানবাহনে তোলে। এরপর সুযোগ বুঝে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে অচেতন ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। কখনো হাসপাতালেও ভর্তি করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রথম গ্রুপ অর্থাৎ ফেরিওয়ালাই অচেতন ব্যক্তির সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলছেন, অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা যাত্রীবেশে বিভিন্ন রুটের বাস, লঞ্চ ও রেলগাড়িতে ক্যানভাসার এবং সাধারণ যাত্রী বেশে উঠছে। চলন্ত বাস, লঞ্চ ও রেলগাড়িতে অবস্থানরত যাত্রীদের টার্গেট করে কৌশলে নেশাজাতীয় উপাদান খাইয়ে অচেতন করে। পরে সুযোগ বুঝে সর্বস্ব লুট করে পালিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় নেশাজাতীয় উপাদানের মাত্রা বেশি হলে অচেতন ব্যক্তি মারাও যায়। রোজার আগে থেকেই এদের অপতৎপরতা রুখতে গোয়েন্দারা অভিযানে নেমেছে। পুরো রমজান মাসজুড়েই অভিযান চলবে। ডিএমপি ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান জানান, ঈদকে সামনে রেখে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে। এরপর কৌশলে অজ্ঞান করার ওষুধ মেশানো খাবার খাইয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ফুটপাতের চা বিক্রেতাসহ ছোট দোকানদাররাও তাদের দলের সদস্য। কৌশলে চা কিংবা অন্য কোনো খাবারের সঙ্গে অচেতন করার ওষুধ মিশিয়ে সহজ-সরল মানুকে সর্বস্বান্ত করছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, প্রতি বছর বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে এদের তৎপরতা বেড়ে যায়। অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যদের গ্রেফতারে র‌্যাব নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের বেশকিছু সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। যানবাহনের যাত্রী বা পথচারীদের উচিত অপরিচিত কারও দেওয়া কিছু না খাওয়া।

সর্বশেষ খবর