বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

খোলা আকাশের নিচে কাটে শান্তিরক্ষীদের রাত

শিমুল মাহমুদ, মালি থেকে

বিশ্বশান্তি রক্ষায় বলিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সুশৃঙ্খল পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে দিনের পর দিন যাযাবর জীবন যাপন করতেও বাধ্য হন। দুর্গম ঝুঁকিপূর্ণ দীর্ঘ পথে জাতিসংঘের পণ্যবাহী যানবাহনগুলোকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে গিয়ে রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয় তাদের। পথে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আক্রমণ কিংবা পুঁতে রাখা আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণের ঝুঁকি ছাড়াও আছে ধূলিঝড়সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা। সবকিছু উপেক্ষা করে এক মাস কিংবা ৪০ দিন পর একেকটি মুভ গন্তব্যে পৌঁছায়। মালিতে নিয়োজিত এক শান্তিরক্ষী বলেন, আমরা যখন কনভয় নিয়ে মুভ করি তখন জীবনের কোনো মায়া থেকে না। নিরাপত্তার কারণে রাতে চলাচল বন্ধ থাকে। তখন খোলা মাঠেও আমাদের তাঁবু টাঙিয়ে থাকতে হয়। সেখানেই রান্না, খাওয়াসহ পরবর্তী ভোরের অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় ডাক্তার, নার্স, কুক পর্যন্ত কনভয়ের সঙ্গে থাকেন। মালির রাজধানী বামাকোয় নিয়োজিত বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সদস্যদের মূল কাজ হচ্ছে বামাকো থেকে কিদাল কিংবা দূরবর্তী স্থানে মোতায়েন শান্তিরক্ষীদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। এ কাজটি তারা নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দক্ষতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। মরুভূমির দুর্গম পথে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তারা রসদসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন কিদালে। পথিমধ্যে রয়েছে বিদ্রোহীদের হামলা ও মাইন আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে মরুঝড় ও বালুঝড় প্রায়ই আঘাত হানে গাড়িবহরকে। এ সময় গাড়িগুলো থামিয়ে দু-তিন দিন পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে গাড়ির চাকা বসে যায়। কিদালে রসদ সরবরাহ করা হয় বামাকো থেকে সড়কপথে। তবে এ পথকে সড়ক বলা যায় না। সড়কের অধিকাংশ জায়গায়ই রয়েছে মাইন বিস্ফোরণের ভয় ও বিদ্রোহীদের হামলার আশঙ্কা। বিদ্রোহীরা রাস্তায় চৌম্বক মাইন পুঁতে রাখে। চলন্ত গাড়িতে মাইন নিক্ষেপ করে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। তা ছাড়া রয়েছে ধূলিঝড় ও অত্যধিক তাপমাত্রা। অত্যধিক তাপমাত্রায় অনেক সময় গাড়ির চাকা ফেটে যায়। রসদ পরিবহনে অনেক সময় লাগার কারণে মাছ, মাংস, শাক-সবজি ইত্যাদি ৩০-৪০% নষ্ট হয়ে যায়। মালিতে বর্তমানে ১১ হাজার ৩৩৮ জন ট্রুপস ও মিলিটারি স্টাফ মিলিয়ে ১৩ হাজার ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। এসব শান্তিরক্ষীর নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিরাপদে পৌঁছে দিতেই চার বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি। ব্যানট্রান্সপোর্টের কনটিনজেন্ট কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এফতেখার উদ্দিন বলেন, এক বছর ধরে আমরা ১৯টি কনভয় মুভ পরিচালনা করেছি এবং কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই কাজ শেষ করেছি। ২০১৪ সালে মালির বামাকোয় বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কনটিনজেন্ট চালু করে। ইউএন আমাদের সরকারের কাছে প্রাথমিকভাবে দুটি ট্রান্সপোর্ট কনটিনজেন্ট চালুর অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকায় একটি দিতে পেরেছি। তিনি বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছর মালিতে আমরা একক ট্রান্সপোর্ট কনটিনজেন্ট হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। চলতি বছর থেকে মিসর ও শ্রীলঙ্কা ট্রান্সপোর্ট কনটিনজেন্ট দিয়েছে। তবে পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করার ধারাবাহিকতায় অন্যদের তুলনায় আমাদেরটা অনেক ভালো। সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকের মতোই মালিতেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। নেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের পরিবেশ। পরিস্থিতি এখানে কতটা ভয়ঙ্কর একটি পরিসংখানই সে সাক্ষ্য দেয়। জানুয়ারি ২০১৬ থেকে গত ২ মে পর্যন্ত মালিতে মোট ৮৯টি হামলা ও নাশকতার ঘটনায় ১১৯ জন শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। সার্বিক ঝুঁকি বিবেচনায় এটিকে বিশ্বের এক নম্বর বিপজ্জনক শান্তিরক্ষা মিশনের ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ।

সর্বশেষ খবর