শনিবার, ২৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিষ্ঠুর ডার্টি পিল

মির্জা মেহেদী তমাল

নিষ্ঠুর ডার্টি পিল

কয়েক মাস আগের ঘটনা। মহাখালীর আরজতপাড়ার একটি বাড়িতে বৃদ্ধা মিলড্রেড গোমেজ মিলু খুন হন। তার অসুস্থ স্বামী ৮০ বছরের অনিল গোমেজের সামনেই দুর্বৃত্তরা তাকে গলা কেটে খুন করে। এ ঘটনায় পুলিশ জামির, পারভেজ ও নাঈম নামের তিন তরুণকে গ্রেফতার করে। পরদিন তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, মহাখালী বস্তি এলাকার ওরা তিনজনই ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের টাকার জন্যই তারা অনিল গোমেজের বাসায় যান। রাতভর বাড়ির ছাদে বসে ইয়াবা সেবন করেন। সাতসকালে ওই বাসায় ঢুকে তারা মিলুকে হত্যার পর লুটে নিয়ে যান মালামাল। ওয়ারীতে ছিনতাইকারীর ছোরার ঘায়ে খুন হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। এ ঘটনায় আবদুর রহমান মিলন ও বেলাল হোসেন সবুজ নামের দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, তারা ইয়াবায় আসক্ত। রাজধানীর দয়াগঞ্জে এক নারীর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। হ্যাঁচকা টানে ওই নারীর কোল থেকে পড়ে ছয় মাসের শিশু প্রাণ হারায়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় গ্রেফতার রাজীব আদালতে স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, তিনি ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য বেপরোয়া হয়ে ছিনতাই করেছিলেন।

এমন ঘটনা এখন বাংলাদেশের নিত্যদিনের। সারা দেশে এমন নৃশংস ঘটনায় আঁতকে ওঠে মানুষ। আর এসব ঘটনায় যারা ধরা পড়ছে, এর বেশির ভাগ মরণঘাতী ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে বাসাবাড়ি, রাস্তায় ছিনতাই, ডাকাতি করছে। টাকা না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত খুন করে ফেলছে। আর খুনের ঘটনাগুলো নৃশংসতায় ভরা। ইয়াবাসেবীদের অপরাধগুলো নৃশংস হওয়ায় এই বড়িকে অনেকেই এখন ‘ডার্টি পিল’ বলে থাকেন। দেখতে কালারফুল হলেও এ পিল মানুষকে নৃশংস করে তোলে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচিত এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার প্রভাব। গত দেড় বছরের অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাদকের কারণে দুই শতাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আর এর অর্ধেকেরও বেশি খুনের কারণ ইয়াবাসংশ্লিষ্ট।

সুস্থসবল মেধাবী শিক্ষার্থীরা পরিবারের অজান্তেই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। টাকার অভাবে জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপকর্মে। রাজধানীর মধুবাজারের ভাড়াটিয়া টিপু মিয়া কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। তিনি জানান, ইয়াবায় আসক্ত সন্তান মনিরের অত্যাচারে পুরো পরিবার অতিষ্ঠ। প্রতিদিনই তাকে নেশার টাকা দিতে হয়। না দিলেই মারধর ও ভাঙচুর চালায় ঘরে। একদিন টাকা না পেয়ে ঘরের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এমনকি টাকা না পেয়ে নিজের ছোটবোনকে অপহরণ করে মা-বাবার কাছে ফোনে টাকা চায় সে। জানিয়ে দেয়, টাকা দিলেই মেয়েকে ফেরত দেওয়া হবে। ১৭ ঘণ্টা পর মাত্র ১ হাজার টাকা দিয়ে ছেলের কাছ থেকে মেয়েকে মুক্ত করেন তিনি। ধানমন্ডির মোরশেদ বলেন, ‘আদরের সন্তান রশিদ কীভাবে যে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে বুঝতেই পারিনি। কলেজে যাওয়ার জন্য টাকা দিতাম। সেই টাকা দিয়ে সে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন করত। ধীরে ধীরে পুরোমাত্রায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কলেজে যাওয়া ছেড়ে দেয়। ঘরের এটা-ওটা চুরি হতে থাকে। টাকা না পেলেই সে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এখন আর ঘরেই থাকে না। ৮-১০ দিন পরপর কোথা থেকে এসে হাজির হয় টাকার জন্য। মানসম্মানের ভয়ে টাকা দিয়ে বিদায় করে দিই।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক কর্মর্কতা বলেন, ‘সব ধরনের মাদকাসক্ত স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আলাদা স্বভাবের হয়। সেই আলাদা স্বভাবের একটি হলো অপরাধপ্রবণতা। এ কারণে মাদককে বলা হয় অপরাধের মা (মাদার অব ক্রাইম)। তবে ইয়াবার উপাদান এমফিটামিন ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু থাকে না। হ্যালুসিনেশন হয়। ‘প্যারানয়েড ডিল্যুশন’ বা সন্দেহপ্রবণতা দেখা দেয়। ইয়াবাকে বলা হয়, ‘মাইন্ড অলটারিং ড্রাগস’। এ মাদক সেবনে সাময়িক উদ্দীপনা বাড়ে, ঘুম কমে যায়, বিরক্তি বাড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়ে। যার ফলে হত্যা-নির্যাতনের মতো নৃশংস কাজ করছেন ইয়াবাসেবীরা। তথ্যানুসন্ধানে ইয়াবায় আসক্তদের নির্মম অপরাধের অনেক ঘটনা পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট মালিবাগের চামেলীবাগে এক ফ্ল্যাটে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তাদের মেয়ে ঐশী রহমান। ১৮ বছরের ওই তরুণী ইয়াবায় আসক্ত ছিল। রূপনগর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে গলায় কাপড় পেঁচানো অবস্থায় হাইওয়ে পুলিশের এএসপি মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় গ্রেফতারের পর শাহ আলম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, মিন্টু, জাকির, ফারুক ও কামাল নামে চারজনের সঙ্গে ইয়াবা সেবন করে তারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গৃহবধূ সাজেদা আক্তার মীমকে হত্যা করেন তার ইয়াবায় আসক্ত স্বামী সামিউল ইসলাম। যাত্রাবাড়ীর পশ্চিম মাতুয়াইলে মাদকাসক্ত বাবা সুমন তার শিশুসন্তান শাহীনকে (৭) দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। সোমা আক্তারকে গলা কেটে হত্যার পর তার স্বামী মনির আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পুলিশ ও স্বজনরা জানান, মনির ইয়াবায় আসক্ত। রামপুরায় সাহানা নামের এক গৃহবধূকে হত্যা করেন ইয়াবায় আসক্ত স্বামী। রাজধানীর শাহজাদপুরে আত্মহত্যা করেন মডেল-অভিনেত্রী রিসিলা বিনতে ওয়াজ। স্বজনরা জানান, রিসিলা ভয়ঙ্করভাবে ইয়াবায় আসক্ত ছিল। কদমতলীর মুজাহিদনগরে ইমরান হোসেন ও বনানীতে মোকারাম আদিল নামের দুই তরুণ আত্মহত্যা করেন। পুলিশ জানিয়েছে, তারা ইয়াবায় আসক্ত ছিলেন। গত বছর জুরাইনে বৃদ্ধ মোহর আলীকে গলা কেটে হত্যা করেন তার ইয়াবায় আসক্ত ছেলে সুমন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, মাদকের সঙ্গে অপরাধের বড় সম্পর্ক রয়েছে। আর প্রচলিত মাদকই অপরাধের বড় কারণ। একেক সময় একেক ধরনের মাদক আসে। এখন ইয়াবার প্রাদুর্ভাব। ফলে ইয়াবার সরবরাহ কমানো বা ব্যবসা বন্ধ করা জরুরি। এতে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর