বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

পানির ন্যায্য হিস্‌সা বঞ্চিত বাংলাদেশ

ছয় নদ-নদীর সমস্যার সমাধান হয়নি

ঝর্ণা মনি

অভিন্ন ৫৪ নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশ। তিস্তার মতোই ঝুলে আছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদ-নদীগুলোর ভাগ্য। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও সাধারণ মানুষের দাবি নানা কৌশলে বার বার উপেক্ষা করছে ভারতের সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলো। দুই দেশের আন্তনদীগুলোর সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য যৌথ নদী কমিশন গঠনের ৪৬ বছর পরও রাজনৈতিক কারণেই সুরাহা হয়নি তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তিসহ অন্যান্য ছয়টি নদ-নদীর পানি বণ্টন চুক্তির। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যে প্রবহমান ছয়টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন চুক্তির আলোচনা দ্রুত শেষ করতে চায় সরকার। নদ-নদীগুলো হচ্ছে মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। ইতিমধ্যে একাধিকবার এসব নদ-নদীর তথ্য-উপাত্তও বিনিময় করা হয়েছে। পরে এ নদ-নদীগুলোর ওপর বাঁধ আছে কিনা বা পানি উত্তোলন করা হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে বাংলাদেশ একাধিকবার জানতে চেয়েছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি। এ ছয়টি নদ-নদীর ওপর কোনো বাঁধ আছে কিনা এবং কী পরিমাণ পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত তা পুনরায় জানতে চাইবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ২০১১ সালের ১০ জানুয়ারি ফেনী নদীর অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির জন্য একটি খসড়া কাঠামো তৈরি করে যৌথ নদী কমিশন। বর্তমানে এর অগ্রগতি নিয়েও কাজ শুরু করেছে কমিশন।

অনিশ্চিত ‘তিস্তা’র ভবিষ্যৎ : ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি হয়েছিল। খসড়া চুক্তি অনুযায়ী তিস্তার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি পাবে ভারত, ৩৭ দশমিক ৫ শতাশ পাবে বাংলাদেশ। বাকি ২০ শতাংশ পানি থাকবে নদীর নাব্য রক্ষার জন্য। কিন্তু ওই সময় তাকে না জানিয়ে পানি বণ্টন চুক্তির হিসাব চূড়ান্ত করা হয়েছিল অভিযোগ এনে শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি সইয়ের ক্ষেত্রে বাদ সাধেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তার আপত্তিতেই এখনো ঝুলে রয়েছে চুক্তির ভবিষ্যৎ। অবশ্য আপাতত আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পশ্চিমবঙ্গের দুই দিনের সফরেও তিস্তার বিষয়ে আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি। ৩০ মে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা চুক্তি করতে সেখানে যাইনি। তিস্তা ব্যারাজ তো আমরা নিজেরা করেছি। ব্যারাজ করে আবার পানি পানি করে আমরা চিল্লাচ্ছি কেন? একটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমস্যার কথা তুলে ধরে তিক্ততা তৈরি করতে চাই না। পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশন কাজ করছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিফলে গেল তোরষা প্রস্তাব, শুষ্ক মৌসুমে পানিহীন দুধকুমার, ধরলা : ভারতের যেটি তোরষা নদী বাংলাদেশ তা দুধকুমার নদ নামে পরিচিত। ২০১৭ সালের এপ্রিলে তিস্তার পরিবর্তে তোরষার পানি ভাগ করার প্রস্তাব দেন মমতা ব্যানার্জি। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তা আর তোরষার অববাহিকা এক নয়। এ ছাড়া এ নদীতে এমন উল্লেখযোগ্য পানি থাকে না, যা দিয়ে তিস্তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তোরষার পানি কখনই তিস্তার বিকল্প হতে পারে না। এ ছাড়া পানি বণ্টন প্রক্রিয়াও সহজ নয়। কারণ তোরষার উৎপত্তি ভুটানে। ফলে তাদের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য অনেক সময় প্রয়োজন। এটি নিয়ে এগোতে হলে ডুয়ার্সের গহিন জঙ্গলের মধ্যে খাল কাটতে হবে। খাল কাটা ছাড়াও সম্ভাব্য জরিপে অনেক সময় প্রয়োজন যা দুটি দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে করা সময়সীমার বাইরে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ধরলা নদীটি ভারতে জলঢাকা নামে পরিচিত। একসময়ের প্রমত্তা ধরলা এখন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর দুঃখ। ভারতের কর্ণপুর হয়ে লালমনিরহাটের মোগলহাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী মাত্র ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধরলা শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে ধু-ধ বালুচর।

তা ছাড়া ভারতের ত্রিপুরা হয়ে সিলেটে নেমে আসা মনু নদের উজানে ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাস শহরের কাঞ্চনবাড়ী এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ত্রিপুরার কুলাই নামক স্থানে ধলাই নদীর বুকে ভারত বাঁধ নির্মাণের কারণে হবিগঞ্জের এ নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। এসব বিষয়ে শিগগিরই বৈঠক করবে যৌথ নদী কমিশন। জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য প্রকৌশলী মো. মোফাজ্জল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে আমরা এখনো আশাবাদী। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মুহুরী, খোয়াই ও গোমতী নদ-নদীর পানি বণ্টনের জন্য যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছে এবং আলোচনা চলছে।’ এ ব্যাপারে সাবেক কূটনীতিক মো. হুমায়ুন কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পানির জন্য ন্যায্য দাবি তোলা উচিত। এটি আমাদের মৌলিক সমস্যা। আমাদের জীবন ও জীবিকা পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিস্তা শুধু নয়, এর সঙ্গে অনেক শাখা নদী জড়িত।’ তিনি বলেন, ‘খসড়া চুক্তির আট বছর পরেও কোনো অগ্রগতি নেই। কারণ, কোনো আলোচনা হয়নি। ২০১১ সালের পর এ বিষয়ে এক পা-ও এগোয়নি।’ যৌথ নদী কমিশন কাজ করছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর