শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য

ঐতিহ্যবাহী ওলন্দাজ কুঠিতে হাসপাতাল

মাহবুব মমতাজী

ঐতিহ্যবাহী ওলন্দাজ কুঠিতে হাসপাতাল

দেড় শ বছর আগে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘ওলন্দাজ কুঠি’ সময়ের ব্যবধানে রূপান্তরিত হয়ে আজ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল।

এ হাসপাতাল হওয়ার আগে ঢাকায় কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে। শুরুতে হাসপাতালটি অসহায় নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। এ ধারা এখনো কিছুটা রয়েছে। পুরনো ছবির সঙ্গে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় মিটফোর্ড হাসপাতালের। বুড়িগঙ্গার পাড়ে বাঁধ ও রাস্তার পাশে মিটফোর্ড হাসপাতাল এখনো দেখতে পাওয়া যাবে। তবে আগের সেই পুরনো ভবনের বদলে আশপাশে উঠেছে বহুতল ভবন। ৮২টি শয্যা নিয়ে শুরু হওয়া মিটফোর্ড হাসপাতাল এখন ৮০০ শয্যার। ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ ও ওলন্দাজ কোম্পানি ১৬০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সতেরো শতকের মধ্যভাগ নাগাদ ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাণিজ্য ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের ছাড়িয়ে যায়। হুগলিতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের পর মোটামুটি সতেরো শতকের মাঝামাঝি ওলন্দাজ ও ইংরেজরা বাংলায় তাদের বাণিজ্য শুরু করে। বাংলার প্রথম ওলন্দাজ ডিরেক্টর পিটার স্টারথেমিস ঢাকায় তাদের ব্যবসা প্রসার করতে থাকেন। ১৭৫০ সালে মুঘল সম্রাট আহমদ শাহ বাহাদুরের সময় ওলন্দাজরা ঢাকায় একমাত্র বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন। মিটফোর্ড হাসপাতালস্থলে কর্মচারীদের আবাসে ব্যবহূত লাল ভবনগুলোই ছিল তাদের বাণিজ্যকুঠি। আর তেজগাঁওয়ে তাদের একটি বাগানবাড়িও ছিল।

ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম আধুনিক হাসপাতাল এই মিটফোর্ড। ঢাকার কালেক্টর এবং পূর্ব বাংলা ও আসামের আপিল বিভাগের বিচারক স্যার রবার্ট মিটফোর্ড যখন ঢাকায়, তখন কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসা-সুবিধা ছিল অপর্যাপ্ত। রবার্ট মিটফোর্ড জনগণের দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন। ইংল্যান্ডে মৃত্যুর আগে তিনি তার সম্পত্তির বেশির ভাগই একটি হাসপাতাল ভবন নির্মাণের জন্য উইল করে দেন। এর পরই বর্তমান স্থানে ১৮৫৪ সালে হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর আগে ওই জায়গায় ওলন্দাজ কুঠি ছিল। চার বছর টানা কাজের পর ১৮৫৮ সালের ১ মে মিটফোর্ড হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। ১৯১৭ সালে এটি প্রথম শ্রেণির হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মিটফোর্ড হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ১৮৭৫ সালে ঢাকা মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালে এটি মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং নবাব পরিবারের অবদানের কথা বিবেচনা করে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নামেই মেডিকেল কলেজটির নামকরণ করা হয়। জানা যায়, ১৮২০ সালে ঢাকায় এসেছিলেন তৎকালীন কালেক্টর রবার্ট মিটফোর্ড। তার সময়ে ঢাকায় কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ লোক মারা যেত। মেডিকেল সুবিধা তখন খুবই অপ্রতুল ছিল। স্যার মিটফোর্ড এ অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হন। যিনি পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হন। ১৮৩৬ সালে মৃত্যুর সময় তিনি তার সম্পত্তি হাসপাতালের জন্য দান করে যান। পরে লর্ড ডালহৌসি এ সম্পত্তির ওপর হাসপাতাল বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৫৫ সালের আগে এটি ‘ওলন্দাজ কুঠি’ ছিল, যা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হতো। ব্রিটিশশাসিত তৎকালীন পূর্ববঙ্গ প্রদেশের এটি প্রথম জেনারেল হাসপাতাল, যেখান থেকে এ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার বৈপ্লবিক যাত্রা। যাত্রার সময় একটি মহিলা ও দুটি পুরুষ ওয়ার্ড নিয়ে এর কাজ শুরু হয়। তখনকার সময়ে এ দেশে মেডিকেল পড়ার জন্য কোনো ইনস্টিটিউশন ছিল না। এজন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে বর্তমান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজটি ১৮৭৫ সালের ১৫ জুন ঢাকা মেডিকেল স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ঢাকা বিভাগের ডিসি ডব্লিউ আর লারমিনি ১৮৮৭ সালের এপ্রিলে একাডেমিক বিল্ডিংয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৮৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলার গভর্নর স্যার স্টুয়ার্ট কলভিন এর উদ্বোধন করেন। প্রায় ১৬ জন স্থানীয় রাজা ও দাতার সহায়তায় ১৮৮৯ সালে মেডিকেল স্কুল বিল্ডিংটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ১২.৮ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ; যা বর্তমানে বাংলাদেশের একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের অন্যতম। এ কলেজে প্রথম বছর প্রায় ৩৮৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ব্রায়ান বঙ্কিম হালদার জানান, বর্তমানে হাসপাতালটিতে আউটডোরে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। ৮০০ বেড পেয়িংসহ থাকলেও প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ জনেরও বেশি ইনডোর রোগী হাসপাতালে অবস্থান করেন।

সর্বশেষ খবর