বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভিআইপির আই ফোন

মির্জা মেহেদী তমাল

ভিআইপির আই ফোন

‘হ্যালো, আমি কাস্টমসের জয়েন্ট কমিশনার আকাশ বলছি।’ ঢাকায় ফোনের একটি বড় শোরুমের ম্যানেজার ফোন ধরেই এমন কথা শুনতে পেলেন। বেশ ভারি কণ্ঠের সেই কাস্টমস কর্মকর্তার নাম শুনেই ম্যানেজার নড়ে চড়ে বসলেন। বললেন, ‘স্যার, ভালো আছেন? বলুন স্যার, কী বিষয়?’ আর বলবেন নাহ! ঈদ আসলেই যত ঝামেলা আমাদের ঘাড়েই। মন্ত্রী, একটি সংস্থার চেয়ারম্যানসহ পাঁচ ভিআইপিকে আইফোন উপহার দিতে হবে। যাকগে ম্যানেজার সাহেব। সময় খুব কম। আমার লোক যাচ্ছে। ৫টা আই ফোন দিয়ে দিবেন। আর আপনাদের ব্যাংক অ্যাকআউন্ট নাম্বারটা ঝটপট বলে ফেলুন’—বিরতিহীনভাবে বলে গেলেন কাস্টমস কর্মকর্তা আকাশ। ম্যানেজার শুনে বললেন, জী স্যার, দিচ্ছি। কোনো সমস্যা নেই। কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘হুম আপনাদের শো রুম সম্পর্কে আমি এবং আমরা খুব ভালো জানি। যাই হোক। আমি নোট করে নিলাম আপনাদের অ্যাকাউন্ট নাম্বার। টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

কিছু সময় পর ম্যানেজার ৫টি আই ফোন কাস্টমস কর্মকর্তার লোকের কাছে পাঠিয়ে দেন। এরপরই ম্যানেজারের ভাইবারে একটি ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজ ওপেন করেই তিনি দেখতে পেলেন কাস্টমস কর্মকর্তা ব্যাংকের টাকা জমার রিসিটটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ম্যানেজার আশ্বস্ত হলেন। মনে মনে ভাবছেন, যাক বাবা বাঁচা গেল। খুব টেনশনে ছিলাম। টাকাটা অ্যাকাউন্টে না এলে কী যে হতো। এভাবেই মনে হয় ফোন ৫টি দেওয়াটা ঠিক হয়নি। যাকগে অ্যাকাউন্টটা একটু চেক করা দরকার। এমন ভাবনার পর ম্যানেজার ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে ফোন দিলেন। অ্যাকাউন্ট চেক করার জন্যে। কিন্তু না টাকা আসেনি। এমন কথা জানার পর ম্যানেজারের বুক কেঁপে ওঠে। টাকা আসবে না কেনো? এমন ভাবতে ভাবতেই ব্যাংক থেকে আবারও ফোন। ম্যানেজার হ্যালো বলার পর ওপাশ থেকে তাকে জানানো হয়, ওই নামে কোনো অ্যাকাউন্ট হোল্ডার নেই। এমন আশঙ্কাজনক কথা শুনে বসে পড়েন ম্যানেজার। তিনি নিশ্চিত হন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি।

শুধু ওই শো রুম নয়, এমন অসংখ্য শোরুম থেকে ঠিক এভাবেই আই ফোন হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। রাজধানীতে শুধু নয়, এরা সক্রিয় সারা দেশে। এ ধরনের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ চক্রের সন্ধান পায়। জানতে পারে প্রতারণার নানা কৌশল।

সমপ্রতি উত্তরা থেকে ধরা পড়ে প্রতারক চক্রের সদস্য সেই আকাশ। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকটি আইফোন। তাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তার এক কন্ট্রাক্ট প্রেমিকা মাহমুদা ইসলাম মৌর নাম জানতে পারে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হলেন এই মৌ। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া নামিদামি ব্র্যান্ডের আইফোন অনলাইনে বিক্রি করতেন চক্রের সদস্য মৌ। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, আগে বিয়ে হলেও স্বামীকে নিজেই তালাক দেয় এ নারী। এরপর একাধিক  প্রেমিক নিয়ে গড়ে তুলে প্রতারক চক্র। আকাশও তার  প্রেমিক ও প্রতারক চক্রের একজন সদস্য। কর্মকর্তারা বলেন, এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে গত কয়েক বছরে কোটি টাকার সম্পদ করেছে মৌ। মিরপুরে রয়েছে একটি নিজস্ব ফ্ল্যাট, রয়েছে দামি গাড়ি। আর এসবই করেছে সে প্রতারণার অর্থ দিয়ে। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ গোয়েন্দাদের বলেছেন, তিনি নবম  শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বিমানবন্দরে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টে কাজ করেন। সেখান  থেকে মোবাইল ফোন ও দামি ব্যান্ডের জিনিসপত্র চুরি করে  প্রেমিকা মৌর হাতে তুলে দিত। আর মৌ সেগুলো অনলাইনে বিক্রি করত।

তাছাড়া প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আয় করে মাসের শুরুতে  প্রেমের শর্ত হিসেবে ৫০ হাজার টাকা তুলে দিত আকাশ। আর এ টাকা দিয়ে পুরো পরিবার চালাত তার প্রেমিকা।

প্রেমিকার জন্য বিভিন্ন সময় মোট ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছে। তিনটি আইফোন, প্রাইভেট কার ক্রয়ের জন্য চট্টগ্রামের মোটর পার্টস ব্যবসায়ী সুমনকে ১৭ লাখ টাকা পাঠানো, চায়নায় মোবাইল এক্সেসরিস সাপ্লাইয়ার এমিকে ৬ লাখ টাকা, দুবাইয়ে ক্যামেরার লেন্স ও ফ্ল্যাস লাইট সাপ্লাইয়ার মাইকেলকে ৪ লাখ টাকা পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন আকাশ।

আকাশ গোয়েন্দাদের আরও বলেছেন, বড় কোনো প্রতারণার টার্গেট সফল হলে আকাশ মৌকে নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দিত এবং এক সঙ্গে রাতযাপন করত। গোয়েন্দারা জানায়, বিভিন্ন পরিচয়ে দোকানে ফোন দিয়ে আইফোন অর্ডার করত এ প্রতারক চক্রের সদস্যরা। আকাশকে  গ্রেফতারের পর তাদের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী ওই ম্যানেজার বলেন, ঈদের আগে কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ফোন দিয়ে পাঁচটি আইফোন অর্ডার করেন আকাশ। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বও চেয়ে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে টাকা পেমেন্ট করেন। এই চক্রের সদস্যরা এভাবে আরও একাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দামি মোবাইল ফোন হাতিয়ে নিয়েছেন।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ‘ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে গোয়েন্দারা। অনুসন্ধানে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।’ আকাশ ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, ব্র্যাক ও মধুমতি ব্যাংকের ক্যাশ রিসিভ এবং সিল জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন শোরুম থেকে আইফোন হাতিয়ে নিতেন। এ ধরনের চক্র সক্রিয় রয়েছে সারা দেশে। তাদের মূলত টার্গেট বড় বড় শোরুম। সেখানে বিভিন্ন পরিচয়ে প্রতারণা করে থাকেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর