মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ডিজিটাল অপরাধী

মির্জা মেহেদী তমাল

ডিজিটাল অপরাধী

ভাই, ভীষণ বিপদ। আমার ৬ হাজার টাকা লাগবে, এক্ষুণি। পাঠাতে পারবেন? আমার ফোনেও টাকা নেই। তাই আপনাকে ফোন করতে পারছি না। বিকাশ নম্বরটাও দিয়ে দিলাম।’ লিটনের ফেসবুকের মেসেঞ্জার ইনবক্সে হঠাৎ এসএমএস আসে তার মামাতো ভাই কিরনের। শান্তশিষ্ট ও ভদ্র মামাতো ভাইয়ের বার্তা পেয়ে লিটন ভাবেন, নিশ্চয়ই বিশেষ প্রয়োজনে টাকা দরকার পড়েছে কিরনের। ও তো টাকা চাওয়ার মতো ছেলে নয়। আশপাশে হয়তো কোনো ব্যাংকের বুথও নেই। সাত-পাঁচ না ভেবেই তার পাঠানো বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। বিকাল বেলা লিটনের সঙ্গে তার মামাতো ভাই কিরনের দেখা হয়। লিটন জানতে চায়, তার বিপদ কেটেছে কিনা। টাকা লাগবে কিনা আরও। এ কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকায় কিরন। লিটনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরন বলে, ‘কিসের বিপদ! টাকা লাগবে মানে? আমি তো আজ মাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।’ পরে দুজনই বুঝতে পারে ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। কিরন তার ভাইকে জানায়, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে। যে কারণে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছে না। একপর্যায়ে অনেক কষ্টে তার হ্যাক হয়ে যাওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ফিরে পান। পরে পোস্টে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেন। কিরন জানতে পারে তার নামে ইতোমধ্যে অসংখ্য বন্ধুর কাছে এভাবে টাকা চাওয়া হয়েছে। শুধু লিটন বা কিরন নয়, ডিজিটাল অপরাধীর ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। ফেসবুক-বিকাশের মাধ্যমে এভাবে প্রতিদিন নিত্যনতুন প্রতারণার জালে পা দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। না বুঝে প্রতারকদের টোপে নিঃস্ব হচ্ছেন বিকাশ গ্রাহক কিংবা সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেসবুক হ্যাক করার পর আইডির প্রকৃত মালিকের কাছেও টাকা দাবি করছে ডিজিটাল অপরাধীরা। টাকা দিলে ফেরত দেওয়া হয় আইডি। প্রতিদিনই এ রকম অভিযোগ আসছে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে। তবে যে হারে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, সে হারে মামলা হচ্ছে না। অর্থাৎ মানুষ ঝামেলা এড়াতে পুলিশের কাছে যান না। তাই ডিজিটাল এই প্রতারণার জাল কতদূর গড়িয়েছে সে বিষয়ে অনেকটাই অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ডিজিটাল এসব ফাঁদ প্রতিরোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। রাজধানীসহ সারা দেশে ঘটে চলেছে একের পর প্রতারণার ঘটনা। ফেসবুকে বন্ধু পাতিয়ে চলেছে প্রতারণার। কখনো শারীরিক সম্পর্কের টোপ দেওয়া হচ্ছে, কখনো আবার নিখুঁত প্রেমের গল্প বানিয়ে চলছে দেদার প্রতারণার। সাধু বাবা-জিনের বাদশা সেজে কিংবা বিকাশ অফিসের কর্মকর্তা সেজে এমন ডিজিটাল সাইবার প্রতারণা চক্রের খপ্পরে পড়ে হাজার হাজার টাকা খুইয়েছেন অনেকে। গাড়ি-বাড়ির লোভ দেখিয়েও সর্বস্বান্ত করছে গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের। বনশ্রীর এক গৃহবধূর কাছে মোবাইল কোম্পানির কর্মকর্তা সেজে কল দিয়ে তাকে দামি প্রাইভেটকার দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ৭/৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা রয়েছে। আবার প্রযুক্তির এই প্রতারণার ফলে অনেকেরই সংসারে ভাঙন লেগেছে। ভুক্তভোগী গ্রীন রোডের সবুজ বলেন, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ওই আইডি থেকে কমপক্ষে ৫০ জন ফ্রেন্ডের কাছ থেকে বিকাশে টাকা চেয়েছে হ্যাকাররা। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নতুন নতুন কৌশলে অন্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির হ্যাকার চক্র। যে কারণে ফেসবুক এখন চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ভুক্তভোগী সবুজ জানান, আমার ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার হ্যাক করে আমার বন্ধুদের কাছে কে বা কারা টাকার জন্য ম্যাসেজ দিচ্ছে। আমি কিছুই জানি না। আমার এক বন্ধু প্রথমে ফোন করে আমার কাছে কুশলাদি জানার পর আমাকে বলে দোস্ত তুমি কি কোনো ম্যাসেজ দিয়েছো। আমি বলি, কেন কিসের ম্যাসেজ। তখন বলে ঘটনাটি। এমনি হ্যাকিংয়ের কবলে পড়েন ধানমন্ডির বাসিন্দা এক প্রবাসীর স্ত্রী। ফেসবুক হ্যাকাররা এই ফেসবুক আইডিটি প্রথমে হ্যাক করে। পরে তার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা মাহফুজ আহমেদ ও আবদুল করিম নামের ব্যক্তিদ্বয়ের কাছে খুব জরুরি প্রয়োজনে ২ হাজার টাকা চান এবং এই ২ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে নিবেন যা আগামী মাসে ফেরত দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন। হ্যাকারদের কথায় সাড়া দিয়ে একটি বিকাশ নম্বরে ২ হাজার বিকাশ করেন একজন। অন্যজনের সন্দেহ হলে তিনি খোঁজখবর নিয়ে দেখেন ওই নারী কারও কাছে কোনো টাকা চাননি। তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। একইভাবে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর আইডি হ্যাক করে তার স্বজনদের কাছ থেকে টাকা দাবি করা হচ্ছিল। থানায় জিডি করার বিষয়টি জানাজানি হলে তার আইডি ফেরত পান তিনি। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, আপনার যত কাছের লোকই হোক না কেন সে যদি ফেসবুক থেকে মেসেজের মাধ্যমে টাকা চায়, প্রথমে ফোন দিয়ে কনফার্ম হোন। তার পরে টাকা পাঠাবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর