শিরোনাম
সোমবার, ২৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

যমজ সিম

মির্জা মেহেদী তমাল

যমজ সিম

মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা আবু জাফর মানিক। বিকাশের মাধ্যমে একটি চক্র তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ৫১ হাজার টাকা। তিনি রামপুরা থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডির কর্মকর্তারা তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র খুঁজে পান। তা ধরে তারা অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধানে তারা জানতে পারে, নম্বর তিনটির একটি ফরিদপুরের সুধাংশু কুমার রাজবংশীর নামে, একটি জামালপুরের এক গার্মেন্টকর্মী খোরশেদ আলম ও আরেকটি ফরিদপুরের নার্গিস বেগমের নামে নিবন্ধন করা। পরে সিআইডি            সুধাংশু কুমার রাজবংশীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সিআইডি নিশ্চিত হয়, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। স্থানীয় এক দোকানদারের কাছ থেকে সুধাংশু সিম কিনেছিলেন। অর্থাৎ ওই দোকানদারই তার নামে আরও সিম রেজিস্ট্রেশন করে বিক্রি করেছেন। যার একটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, ‘এই মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, যার নামে সিমটি নিবন্ধন করা তিনি খুবই দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ। তিনি জানেনই না তার নামে আরও সিম নিবন্ধন করে কেউ ব্যবহার করছে। আমরা সম্প্রতি রংপুর থেকে সিম জালিয়াতি করে বিক্রি করা একটি চক্রকে খুঁজে পেয়েছি। তারাও বিভিন্ন কৌশলে সাধারণ মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর নিয়ে সিম নিবন্ধন করে প্রতারক-সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করত।’

আশঙ্কাজনক তথ্য পাওয়া যায় বিকাশের মাধ্যমে ৪০ লাখ টাকার একটি প্রতারণার অভিযোগের তদন্তে। রাজধানীর রমনা থানায় করা প্রতারণার অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দারা হতবাক। তারা জানতে পারেন, এই প্রতারণার জন্য ৩৮টি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করেছে প্রতারক চক্রের সদস্যরা। প্রতিটি নম্বরই অন্যের নামে নিবন্ধন করা। নম্বরগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ফরিদপুরের একটি এলাকা থেকে। মোবাইল ফোন নম্বরগুলো দিয়ে যে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে তাও জালিয়াতির মাধ্যমে করা। সিম নিবন্ধনে দেওয়া ছবির সঙ্গে বিকাশ অ্যাকাউন্টের ছবি বা জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি এবং তথ্যের কোনো মিল নেই। এর মধ্যে দুটি নম্বর রয়েছে যা একই জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে নিবন্ধন করা হয়েছে। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের একজন বাসিন্দার নামে নিবন্ধন করা হলেও গ্রামীণফোনের গ্রাহক নিবন্ধন ফরমে দুই ধরনের ছবি দেওয়া রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান তার নামে সিম দুটি নিবন্ধন করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, জালিয়াতি করে অন্যের নামে নিবন্ধন করা মোবাইল ফোন সিমের বড় গ্রাহক অপরাধীরা। ফোন ব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্ম করা, অপরাধ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো এবং আত্মগোপনে থেকে যোগাযোগ রক্ষার জন্য অপরাধীরা বেশি দামে এসব সিম কিনে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধারণত মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড বা সিডিআর বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীরা জালিয়াতি করে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করায় বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ অপরাধীদের বেশির ভাগেরই সিডিআর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেটি এমন একজনের নামে নিবন্ধন করা, যিনি বিষয়টি জানেনই না। মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক অপরাধ ঠেকাতে জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম রেজিস্ট্রেশন শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন করা হয়েছিল তা পুরোপুরি সাফল্য পায়নি। পুলিশের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, শতকরা ৯৫ ভাগ অপরাধী এখন অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করছে। কোনো অপরাধ সংঘটনের পর অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ মোবাইল ফোন নম্বরের কল ডিটেইলস রেকর্ড সংগ্রহ করছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যার নামে সিমটি নিবন্ধন করা তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। সাইবার ক্রাইম বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফেইক সিম অপরাধী বা প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিকাশ-প্রতারণা, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, হুমকি, মাদক ব্যবসা, চোরাকারবার এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজেও ব্যবহার করছে।’

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, জালিয়াতির সিম দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে। কিন্তু অপরাধীদের শনাক্ত করতে বা ধরতে গিয়ে তারা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর যে মোবাইল ফোন নম্বরটি পাওয়া যায়, দেখা যায় যার নামে এটি নিবন্ধিত, তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। মূল অপরাধীরা আড়ালে থাকার কারণে অনেক সময় সাধারণ মানুষ হয়রানিরও শিকার হচ্ছেন।

ঢাকার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জঙ্গিরাও জালিয়াতির মাধ্যমে নিবন্ধন করা সিম ব্যবহার করে যোগাযোগ করছে। তারা এক জঙ্গির বিষয়ে মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেন সেই নম্বরটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক বৃদ্ধার নামে নিবন্ধন করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিচিত নম্বর থেকে মিসড কল এলে কল ব্যাক করার আগে ভালো করে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে হবে যে এটি কার নম্বর। অথবা কল ব্যাক করা বন্ধ রাখতে হবে। ডাইরেক্ট রিং হলে সেটি রিসিভ করলে সিম ক্লোনিংয়ের শিকার হবেন না। মিসড কল এলেই সতর্ক থাকতে হবে। যদি দেখা যায় সেল ফোনের ব্যালান্স অকারণে কমে যাচ্ছে। তখনই সেল ফোনটি বন্ধ করে অন্য একটি নম্বর থেকে নিজের নম্বরে ফোন দিয়ে চেক করতে হবে। রিং হলে বুঝতে হবে একই নম্বরে সিম কাজ করছে। এটা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের কাছে খবরটি জানাতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর