মঙ্গলবার, ২৬ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

ডার্টি পিল-এ সব শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

ডার্টি পিল-এ সব শেষ

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (আইইউবি) বিবিএর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শিহাবুর রহমান। ঢাকার আদাবরে তাদের বাসা। তার বাবা-মা এবং ছোট ভাই তাকে বাসায় রেখে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে যান। তিন দিন পর ঢাকা থেকে খবর যায় তাদের কাছে। ফ্ল্যাট থেকে পচা গন্ধ বেরুচ্ছে। এমন খবরের পর তারা নিজেদের বাসায় ফিরে আসেন। ফ্ল্যাটের সামনে পুলিশ। প্রচুর লোকজন। তারা ফ্ল্যাটের ভিতরে গিয়ে দেখেন শিহাবের লাশ পড়ে আছে। পচে যাওয়ায় দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল।

শিহাবের বাবা আদাবর থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করেন। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। খুনি বাইরের কেউ নয়। খুনি শিহাবের ছোট ভাই সিফাতুল ইসলাম। পিলখানার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কেন ভাইকে খুন করেছ? এমন প্রশ্নে সিফাতের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আরেক নির্মম কাহিনী। সিফাত জানায়, ‘বড় ভাই ছিল ডার্টি পিলে (ইয়াবা) আসক্ত। তার আচরণ এমন এক পর্যায়ে ছিল, সে কিছু মানত না। টাকার জন্য বাসার সব তছনছ করেছে। ভাঙচুর করেছে ঘরের আসবাবপত্র। বাবার জমানো ব্যাংকের টাকাও সব শেষ করেছে ইয়াবার পেছনে। কয়েক বছর ধরে তার অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করছে পুরো পরিবার। কিন্তু সে যখন বাবা মাকে মারধর করতে শুরু করল, তখন আর সহ্য করতে পারিনি। বড় ভাইকে জবাই করে হত্যা করি। হত্যার পর বাবা মাকেও জানিয়েছি। বাবা মা আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যায়। বিষয়টি ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করি।’ পুলিশ সিফাতকে জেলে পাঠায়। এক ছেলে খুন হলো। আরেক ছেলে জেলে। বাবা মায়ের আহাজারি যেন দেখার কেউ নেই। এক সময়ের হাসিখুশি পরিবারটির সব কিছু ডার্টি পিলের কারণে শেষ হয়ে যায়। সম্প্রতি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা নিজ বাসায় বিষাক্ত কিছু সেবন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তাঁর স্বামী দ্রুত তাঁকে নিয়ে আসেন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। চিকিৎসকদের চেষ্টায় বেঁচে যান তিনি। সুস্থ হওয়ার পর ওই শিক্ষিকা কান্নায় মুষড়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে আমার গায়ে হাত তুলবে, তার পরও আমি বেঁচে থাকি কী করে!’ একটু শান্ত হয়ে বলেন, ‘নিজে অনেক কষ্ট করে আজকের অবস্থানে এসেছি। সন্তানটিকে কোনো রকম কষ্টের ছোঁয়া লাগতে দিই না। তাঁর জন্য সব কিছু উজাড় করে দিচ্ছি;  চেয়েছি শুধু ভালো একটা মানুষ হয়ে বেড়ে উঠুক  ছেলেটা। কিন্তু এই বয়সেই ছেলেটার এমন সর্বনাশ হয়ে যাবে, ভাবতেও পারিনি।’

তিনি জানান, তাঁর একমাত্র সন্তানটি ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করছিল। হঠাৎ করেই  ছেলেটির বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাকে নিয়ে তিনি প্রথমে যান একজন বক্ষব্যাধি চিকিৎসকের কাছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে ছেলেটির ফুসফুসে পানি জমে জটিল অবস্থা ধারণ করেছে। চিকিৎসার সময়  ছেলেটির এক বন্ধুর মাধ্যমে তিনি খবর পান, তাঁর একমাত্র সন্তানটি নিয়মিত সিসা ও ইয়াবা সেবন করে। আরও খোঁজ নিয়ে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর এ নিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই ছেলে উত্তেজিত হয়ে আঘাত করে তাঁকে।

ধানমন্ডি এলাকার একটি মাদক নিরাময়কেন্দ্রে গিয়ে বনানী এলাকার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী নিজের মাদকাসক্ত সন্তানকে রক্ষার পরামর্শ চান কর্তব্যরত চিকিৎসকের কাছে। ‘ছেলেটা আমার ক্লাস এইটে পড়ছে। কিছু দিন আগে ও সিসা নিত। এর মধ্যে জানলাম ইয়াবা ধরেছে। একদিন বাসায় ওর বেডরুমে গোলাপি রংয়ের কী সব ট্যাবলেটও পেলাম। কীভাবে যে এমন সর্বনাশটা হলো, বুঝতেই পারলাম না। একদিন থানা থেকে ফোন আসার পর জানতে পারলাম বিষয়টা। এখন আমার সন্তানটাকে আপনারা বাঁচান। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বললেন, ‘ছেলেটা এখন একদিকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে।’

এমন ঘটনা এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। ডার্টি পিলে ধ্বংস হচ্ছে পরিবার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইদানীং স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে, বিশেষ করে হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মিডিয়া কর্মী সব  পেশার মানুষই মাদকের মতো মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গাঁজা দিয়ে শুরু করে তারা সর্বস্বান্ত হচ্ছে ডার্টি পিলে। এর মাধ্যমে তারা নিজেরা শেষ হচ্ছে, পরিবারকে একেবারে নিঃস্ব করে দিচ্ছে, অন্যদিকে জাতি নিমজ্জিত হচ্ছে অতল গহ্বরে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এমন সব তথ্য যা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, আঁতকে উঠতে হয় এ জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। কোথায় যাচ্ছি আমরা। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রজন্ম। ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে একটি জাতি যা ওপরে থেকে কোনোভাবেই বুঝার উপায়  নেই। যে যুবকরা এই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভবিষ্যৎ পানে; তাদের একটি বড় অংশই আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে মাদকের ‘বিষে’। নীল বিষ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। শিল্পপতির সন্তান থেকে রিকশাওয়ালার সন্তান সবাই আক্রান্ত এই বিষে।

সর্বনাশা মাদকের ছোবলে বিপন্ন হওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের ঘটনা বেশ আলোচিত। রাজধানীর চামেলীবাগের বাসায় বাবা এসবির পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে তাঁদেরই কন্যা ঐশী রহমান। ঐশী এখন জেলহাজতে। আর তার সাত বছরের ছোট ভাইটি বেড়ে উঠছে এক অসীম শূন্যতায়। জানা গেছে, নাচের পার্টিতে গিয়েই সর্বনাশ হয় ঐশীর। ডান্স মাস্টার জনি ও মিজানুর রহমান রনির হাত ধরেই মাদকাসক্ত হয় সে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তির কারণে অনেকেই ঐশীর মতো হিংস্র হয়ে উঠছে। যেসব পরিবারে হত্যাকাণ্ড ঘটেনি তারাও আছে চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায়। মাদকাসক্ত সন্তান তছনছ করছে ঘরের জিনিসপত্র। মারধর করছে স্বজনদের। অতিষ্ঠ হয়ে মা-বাবা নিজেই ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই মাদকাসক্তির হার বেশি। মা-বাবার সম্পর্ক খারাপ থাকলে অনেক সময় সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে অভিভাবকদের সন্তানের ব্যাপারে জানতে হবে। তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী এখন বিত্তবানদের সন্তানদের টার্গেট করছে। তিনি বলেন, একজন মাদকাসক্ত তরুণী তার মা-বাবাকে খুন করেছে; একজন সন্তান কিন্তু তার মা-বাবাকে খুন করেনি। মাদকাসক্তির কারণে ঐশী নামের ওই তরুণীর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। এর পরই সন্তান হয়েও মা-বাবাকে খুন করার মতো ভয়ানক কাজটি করতে পারে। এমন কিছু ঘটনা আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতির আগেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধবিজ্ঞানেও মাদককে সব অপরাধের ‘মা’ বলা হয়। কারণ মাদকাসক্তদের পক্ষে সব অপরাধ করা সম্ভব। আর সব অপরাধীরও মাদকাসক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। এটি পরস্পর নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। সমাজে অস্থিরতা ও পরিবেশের কারণে মাদকাসক্ত হতে পারে  যে কেউ। এ ধরনের গোপন অপরাধের জন্য মানসিক অসুস্থতা অনেকাংশে দায়ী।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর