শুক্রবার, ২০ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

নারী উন্নয়নে উচ্চতায় বাংলাদেশ

ঝর্ণা মনি

নারী উন্নয়নে উচ্চতায় বাংলাদেশ

নিজ দেশে অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ গেমসে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। হংকংয়ে চার জাতি জকি কাপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। ধারাবাহিক এই সাফল্যে তাদের নিয়ে আরও সাহসী হয়ে ওঠার রসদ পেয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। তাই এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে দৃষ্টি এবার যুক্তরাষ্ট্রে। ইতিমধ্যে উত্তর আমেরিকার দেশটির অনূর্ধ্ব-১৫ কনকাকাফ খেলার আগ্রহ প্রকাশ করে নিবন্ধন করেছে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের তিনটি ভাগ ডিভিশন টুতে খেলতে চান বাংলাদেশের অদম্য নারী ফুটবলাররা।

বর্তমান সরকারের ৯ বছরে নারীর ক্ষমতায়নে অর্জন অনেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে  সরকার। আর তাই বাংলাদেশের নারীর বিজয় পতাকা উড়ছে এভারস্টের চূড়া থেকে ফুটবল-ক্রিকেট মাঠ অবধি। অবশ্য এ জন্য মিলছে একের পর এক বৈশ্বিক স্বীকৃতি। সর্বশেষ (২৭ এপ্রিল) এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকার জন্য শেখ হাসিনাকে এবার গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল সামিট অব উইমেনস’। নারীর ক্ষমতায়নে ২০১৬ সালে জাতিসংঘের ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন শেখ হাসিনা। নারীর ক্ষমতায়নে গত ৯ বছরে বেশ কিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১; মনোসামাজিক কাউন্সেলিং নীতিমালা, ২০১৬ (খসড়া); জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নকল্পে কর্মপরিকল্পনা, ২০১৩-২০১৫; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০; ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন, ২০১৪; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৩; বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের মান হিসেবে ’গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট, ২০১৬’ অনুযায়ী বাংলাদেশ ষষ্ঠ স্থানে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী নারীর সব ক্ষেত্রে ক্ষমতায়নে ১৪৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে ভালো। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। নারীদের আত্মমর্যাদা নিয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেয়েরা যখন কাজ করে, আমি মনে করি খুব ভালোভাবে করে। তাদের কাজের দক্ষতা অনেক বেশি, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি চাই আমাদের বোনেরা একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে, আত্মমর্যাদা নিয়ে চলবেন।’

নারীর উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি তাদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতেও সহায়ক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে দুই ধাপে ছয় মাস করা, সন্তানের পরিচয়ে বাবার সঙ্গে মায়ের নাম যুক্ত করা, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে ছেলের পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা নিশ্চিত করা, মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে ‘তথ্য আপা’ প্রকল্প চালু, নগরভিত্তিক প্রান্তিক মহিলা উন্নয়ন প্রকল্প, নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, অতিদরিদ্র ১০ লাখ মহিলার দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া, নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা দেশে বিক্রির জন্য নারীবান্ধব বিপণন নেটওয়ার্ক ‘জয়িতা’ গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া তৃণমূলের নারীদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬টি পল্লী মাতৃস্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশুর যত্নসহ যাবতীয় বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হচ্ছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্রামীণ নারীরা যেন কোনোভাবেই পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ রেখে তারা ইনকাম জেনারেটিং প্রোগ্রামের আওতায় ড্রাইভিং, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৮টি ট্রেডে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা নারীদের যাতায়াত ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে হাসপাতাল স্থাপনের অংশ হিসেবে প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে নারীদের প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। মেটারনাল হেলথ ভাউচার স্কিম চালুর মাধ্যমে গর্ভধারিণী মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে নিরাপদ সন্তান প্রসব এবং প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে নারী ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। ওসিসি থেকে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত মোট ২১ হাজার ৪০৩ জন নারী ও শিশুকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই সেন্টারে টোলফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, তাদের পরিবার এবং সংশ্লিষ্ট সবাই প্রয়োজনীয় তথ্য, পরামর্শসহ দেশে বিরাজমান সেবা ও সহায়তা সম্পর্কে জানতে পারেন। এসব বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম এনডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা ও ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা চালু করা হয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন এবং নারী উন্নয়ন-সংক্রান্ত ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪৩২ জন শিক্ষিত বেকার নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকার নারীর ক্ষমতায়নে চলতি অর্থবছরে ১৮ লাখ ২০ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, সরকারি চাকরিতে নারী কর্মকর্তার হার ২০২০ সাল নাগাদ ২৫ শতাংশে উন্নীত করা, ২০ থেকে ২৪ বছরের নারীদের সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অবশ্য নারীর ক্ষমতায়ন এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি বলে মনে করছেন নারীনেত্রীরা। এ ব্যাপারে মানবাধিকার আইনজীবী ও নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নারীরা বাইরে বেরিয়ে আসছেন এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে সমতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। একদিকে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পুরস্কার পাচ্ছে, অন্যদিকে যত্রতত্র যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী। কারণ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না আমরা। ফলে ক্ষমতায়নের সুফল পাচ্ছেন না নারী।’

সর্বশেষ খবর