রবিবার, ২২ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

অভিযান হবে ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে

তালিকা করা হয়েছে ২০০ জনের, শিগগিরই মাঠে নামবে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা

মানিক মুনতাসির

ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে যাচ্ছে সরকারের একাধিক সংস্থা। ইতিমধ্যে ব্যাংক লুটেরাদের একটি তালিকাও করা হয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে সমন্বয় করে মোটা দাগে ব্যাংক লুটেরা হিসেবে চিহ্নিত এ রকম অন্তত ২০০ জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যাদের ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ ও দলিল রয়েছে তাদেরই কেবল ধরা হবে। এদের সবাই গত কয়েক বছরের বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা উত্তোলন করেছেন। এ তালিকায় সব রাজনৈতিক দলের লোকই রয়েছেন বলে জানা গেছে। ব্যাংক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধার ও লুটেরাদের শাস্তির আওতায় আনতে নীতিগতভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার; যা ব্যাংক খাতের ইমেজ পুনরুদ্ধারে ও গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারকে ব্যাপক জনসমর্থন আদায়ে সহযোগিতা করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অভিযান যৌক্তিক হবে না। কেননা ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম আর মাদক অপরাধ এক বিষয় নয়। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, জাল দলিল-দস্তাবেজ, ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংকে মর্টগেজ দিয়েছেন, ভুয়া এলসি খুলে ব্যাংক থেকে টাকা লুটে নিয়েছেন, এমনকি ভুয়া নাম ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব কোম্পানি খুলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন তাদের এ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এক ব্যাংকের পরিচালক হয়ে অন্য ব্যাংকের পরিচালককে বেআইনিভাবে মোটা অঙ্কের ঋণ দিয়েছেন এমন ব্যক্তিদেরও নাম রয়েছে তালিকায়।

জানা গেছে, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় যারা সহায়তা করেছেন এমন ব্যক্তিদেরও ধরা হবে এ অভিযানে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিচয়কে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যাংক লুটেরা হিসেবে চিহ্নিতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। গত ২৪ জুন রাজধানীর একটি হোটেলে বাজেট আলোচনার এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন ব্যাংক লুটেরাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। এর আগে অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একাধিকবার গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন ব্যাংক জালিয়াত চক্রকে আইনের আওতায় আনার কথা। যত বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিই হোন না কেন ব্যাংক লুটেরা হিসেবে তার বিচার করা হবে। শুধু রাষ্ট্রায়ত্তই নয়, বেসরকারি ব্যাংকের অর্থও যারা লুট করেছেন তাদেরও বিচারের মুখোমুখি করা হবে। জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গোপনে অভিযান চালিয়ে লুটেরাদের ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন বিভিন্ন সময় যে অভিযান চালায় তা আরও জোরদার করা হবে। শুধু ব্যাংক লুটেরাই নয়, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও ধরা হবে। এজন্য ইতিমধ্যে দুদককে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে গত কয়েক বছরে কী পরিমাণ ঋণ জালিয়াতি হয়েছে তার একটি পরিসংখ্যান প্রতিবেদনও নিয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সে পরিসংখ্যান ও ব্যাংকের দেওয়া প্রতিবেদনের পাশাপাশি গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যও সংযোজন করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায়। জানা গেছে, তালিকাভুক্ত ব্যাংক লুটেরাদের তথ্য ইতিমধ্যে কাস্টমস ইমিগ্রেশন পুলিশসহ বিভিন্ন জায়গায়ও পাঠানো হয়েছে। যেন কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনে তালিকাভুক্ত লুটেরাদের পাসপোর্ট জব্দ করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এবারের বাজেটে একটি ব্যাংক সংস্কার কমিশনের ঘোষণার প্রস্তুতি নিলেও বাজেট ঘোষণার শেষ মুহূর্তে এসে অর্থমন্ত্রী সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। ব্যাংক লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে সেজন্যই ব্যাংক সংস্কার কমিশন আপাতত করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে। যারা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাক লুটে নিয়েছেন তাদেরই ধরা হবে। তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার পাশাপাশি কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। কেউ অর্থ ফেরত দিতে না পারলে তার অনুকূলে থাকা বিষয়সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সম্প্রতি ব্যাংক খাতের জালিয়াত চক্র ও ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারি ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ব্যাংক খাতকে পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে এবার এমন অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। শুধু হলমার্ক আর বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারিতেই অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর বাইরে ছোট-বড় অনেক ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে গত ১০ বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণের নামে লোপাট করা হয়েছে; যার ফিরিস্তি করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সেই প্রতিবেদন নিয়েও মাঠে নামবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের অভিযান সম্ভবত এর আগে কখনো হয়নি। ফলে এটা কতটা সফল বা যৌক্তিক হবে তা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর হলে খুব সহজেই ব্যাংক জালিয়াত চক্রকে ধরা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের অভিযান যৌক্তিক হবে না। কেননা ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম আর মাদক অপরাধ এক বিষয় নয়। ফলে ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইমের যে আইন আছে সে অনুযায়ী এ ধরনের অভিযান কতটা যৌক্তিক হবে তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। তবে ব্যাংক খাতে যারা লুটপাট চালাচ্ছেন তাদের ধরতে হলে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। অপরাধী বা জালিয়াত চক্র তো চোখের সামনেই রয়েছে।

সর্বশেষ খবর