বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক

রোহিঙ্গা ফেরাতে তাগিদ মিয়ানমারকে

প্রতিদিন ডেস্ক

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ জোরালো করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। সোমবার ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রোহিঙ্গা নিধনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের অপরিহার্যতা তুলে ধরা হয়। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতার পাশাপাশি বিতাড়িত ব্যক্তিদের রাখাইন রাজ্যের নিজ ভূমিতে ফেরাতে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক নতুন বিশেষ দূত ক্রিস্টিনে শ্র্যানার বারগেনার সম্প্রতি মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন নিরাপত্তা পরিষদের কাছে। এটি ছিল নিরাপত্তা পরিষদের সামনে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণের প্রথম ঘটনা। সেখানে বিদ্যমান সংকট এবং পূর্বাপর পরিস্থিতির ধারাবিবরণী দেন তিনি। এ সময় উদ্বাস্তুবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার ভলকার টার্ক, ইউএনডিপির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সমন্বয়কারী এবং কান্ট্রি অফিসের লিয়াজোঁ-সংক্রান্ত পরিচালক ক্লেয়ার ভ্যান ডারভিরেনও নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বিবৃত করেন এবং বিশেষ দূতের সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করেন। এ সময় বিদ্যমান সংকট এবং এর ভয়াবহতা উপলব্ধিতে নিয়ে জাতিসংঘের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর আলোকপাত করা হয়।

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা জাতিসংঘের মানবাধিকার, ইউএনডিপির সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা-স্মারক অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নৃশংসতার যে অভিযোগ রয়েছে সে ব্যাপারে স্বাধীন ও স্বচ্ছতায় পূর্ণ তদন্তের ওপরও জোর দেন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা। এ সময় মিয়ানমার সরকার ৩১ মে স্বাধীন একটি তদন্ত কমিশন গঠনের যে ঘোষণা দিয়েছে সে বিষয়টিও উল্লেখ করেন সদস্যরা।

নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা মনে করেন, রাখাইন রাজ্যে বর্বরোচিত আক্রমণে গৃহত্যাগে বাধ্য হওয়া লোকজনসহ দেশত্যাগী রোহিঙ্গা মুসলমানেরা যাতে নিরাপদে সসম্মানে বসতভিটায় স্বেচ্ছায় ফিরতে আগ্রহী হন, তেমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে মিয়ানমারকে। একই সঙ্গে হামলায় ক্ষতি হওয়া সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া তথা পুনর্বাসিত হওয়ার প্রয়োজনীয় অর্থ-সহায়তার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ একমত পোষণ করে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সুগম করার ব্যাপারেও মিয়ানমারকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে বলে তারা মনে করেন।

 

মিয়ানমারবিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দূত বলেন, মিয়ানমারের নেতারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী। তবে রাখাইন প্রদেশে শুধু রোহিঙ্গা এবং সরকারের মধ্যেই বিরোধ নয়, সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান ও রাখাইনের অপর জাতিগোষ্ঠী তথা বৌদ্ধরাও মুসলিমবিদ্বেষী।

কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না মিয়ানমার। গত বছর আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব রোহিঙ্গাকে ফেরাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনো শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। এর মধ্যে ৬ জুন মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এবার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পরিষদের সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন।’ মিয়ানমারে জাতিসংঘ দূত ক্রিস্টিন স্ক্রানার বারজানার বৈঠকে বলেন, সরকার পালিয়ে যাওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত আনতে আগ্রহী। তিনি বলেন, সরকার সত্যি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তাদের ফেরত আনতে চায়। বারজানার জানান, রাখাইনের মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের মধ্যে উত্তেজনা এখনো বিরাজমান। তিনি বলেন, ‘তাই তারা তাদের ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে তাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সম্মানের সঙ্গে ও টেকসই উপায়ে ফেরত আসতে হবে।’

১৯৮২ সালে মিয়ানমারে নাগরিকত্বের নতুন আইন প্রণীত হওয়ার আগে সবুজ পরিচয়পত্রে পুরুষ ও গোলাপি পরিচয়পত্রই ছিল মিয়ানমারে বসবাসকারী নিজ দেশের মানুষদের শনাক্ত করার উপায়। সেই পরিচয়পত্র ছিল রোহিঙ্গাদের কাছেও। তখন তারাও স্বীকৃত ছিলেন মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে। ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। কখনো মলিন হয়ে যাওয়া কোনো নিবন্ধনপত্র, কখনো নীলচে-সবুজ রঙের রসিদ, কখনো ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনো আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি। ধাপে ধাপে রংবেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। রোহিঙ্গাদের পরিচয় এখন একটাই—পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন শরণার্থী জনগোষ্ঠী। সূত্র : এনআরবি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর