বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচনী কাজে বিদেশি কাগজ কেনার পাঁয়তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন জাতীয় সংসদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মুদ্রণকাজের জন্য বিদেশি কাগজ কেনার পাঁয়তারা চালাচ্ছে একটি শ্রেণি। দেশীয় মানসম্পন্ন কাগজ উপেক্ষা করে আমদানি করা বিদেশি কাগজ গছিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশন পাওয়ার জন্য ওই শ্রেণিটি উঠেপড়ে লেগেছে। তারা বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের মাধ্যমে কাগজ সংগ্রহের জন্য ডাকা দরপত্রের (টেন্ডার) ভাষায় এমন শর্তজুড়ে দিয়েছে যাতে দেশীয় পেপার মিলগুলো অংশগ্রহণই করতে না পারে। এমনকি সরকারের ক্রয় নীতিমালার লঙ্ঘন করে শর্তের মধ্যে বিদেশি ব্র্যান্ডের নামও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। দরপত্রের শর্তে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও বিদেশি কাগজের উল্লেখ করার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশীয় কাগজ মিলগুলো। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় পণ্যকে উপেক্ষা করে বিদেশি পণ্য কেনার জন্য এ ধরনের শর্ত আরোপের পেছনে মূলত মোটা অঙ্কের কমিশনের বিষয়টি কাজ করছে। এক শ্রেণির আমদানিকারক বিদেশি কাগজ গছিয়ে দিতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত আরোপ করিয়েছে যা সরকারি নীতিমালার পরিপন্থী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আসন্ন সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুদ্রণকাজের জন্য ৫৩ হাজার ২২৭ রিম কাগজ ক্রয়ের লক্ষ্যে গত ২২ জুলাই দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। অফিসের উপ-পরিচালক ছরোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত ওই দরপত্রে প্যাকেজ/পণ্য বর্ণনায় উন্নতমানের সাদা অফসেট কাগজ উল্লেখ করে ব্র্যাকেটে আবার ‘(বিদেশি)’ শব্দটি বসিয়ে দেওয়া হয়। ‘পেপার ওয়ান’ নামে একটি বিদেশি কাগজের নামও সেখানে উল্লেখ করে দেওয়া হয়। বিপিএমএ মনে করছে, এ ধরণের সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও দেশের নাম উল্লেখ করে দরপত্র আহ্বান করা সরকারি ক্রয়নীতিমালার পরিপন্থী।

এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিপিএমএর সচিব একেএম নওশেরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে দেশীয় পণ্যের বিকাশে নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছেন। সেখানে দেশীয় শিল্পকে বাদ দিয়ে বিদেশি পণ্য কিনতে শর্ত দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা সরকারি ক্রয়নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের পারচেজ পলিসি অনুযায়ী বিদেশি পণ্যকে উৎসাহিত করার সুযোগ নেই। সেখানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বিদেশি কাগজ উল্লেখ করে দিয়ে দরপত্র আহ্বান করে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’ বিষয়টি নিয়ে দেশীয় কাগজ শিল্পের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে উদ্বেগ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চিঠি পাঠাবেন বলেও জানান তিনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের উপ-পরিচালক ছরোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পণ্য কেনার বিষয়ে আমাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। সরকারের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ (ডিপিপি) যে ধরনের পণ্য চায় আমরা সে ধরনের পণ্যের দরপত্র আহ্বান করি। নির্বাচনী কাজের জন্য নির্বাচন কমিশন বিদেশি কাগজ চেয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন কমিশন কী চেয়েছে সেটি আমি বলতে পারব না। তবে ডিপিপি আমাদের কাছে বিদেশি কাগজ চেয়েছে। বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, দরপত্র আহ্বানকারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রের শর্তে চাহিদাকৃত কাগজের বিবরণ যেমন-জিএসএম, ব্রাইটনেস, ওপাসিটির মতো কারিগরী বিষয় উল্লেখ করে দিতে পারে। এর ফলে মানসম্পন্ন কাগজ উৎপাদনকারী দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও অধিকসংখ্যক অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে কাঙ্ক্ষিতমানের পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। কিন্তু শর্ত দিয়ে বিদেশি পণ্য উল্লেখ করার বিষয়টি দেশীয় স্বার্থবিরোধী কাজ। আমরা দেশীয় শিল্প যদি বিদেশি কোম্পানির চেয়ে ভাল মানের কাগজ প্রতিযোগিতামূলক দামে দিতে পারি তাহলে কেন আপনি বিদেশি পণ্য কিনতে যাবেন, বলেন দেশীয় কাগজ মিল সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, অন্য দেশগুলো যেখানে দেশীয় পণ্যকে উৎসাহিত করতে এন্টিডাম্পিং শুল্ক বসিয়ে বিদেশি পণ্যকে বাধা দিচ্ছে, সেখানে উল্টো দেশে মানসম্পন্ন পণ্য থাকার পরও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাকা দরপত্রের বিদেশি পণ্য কেনার শর্ত দেওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক। একশ্রেণির আমদানিকারক কমিশন দিয়ে এ ধরনের শর্ত আরোপের পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে বলে মনে করছেন দেশীয় কাগজ কল-সংশ্লিষ্টরা। বিপিএমএ-এর তথ্য অনুযায়ী, কাগজশিল্প বাংলাদেশের একটি শুরুত্বপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পন্ন শিল্প খাত। দেশে এখন ছোট বড় মিলিয়ে ১০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এসব কাগজ মিলে বর্তমানে বিশ্বমানের সব প্রকার কাগজ উৎপাদিত হয় যা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি কাগজের সমকক্ষ। বর্তমানে সরকারি দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয়করা দেশীয় উন্নতমানের কাগজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্যবহূত হচ্ছে। এ ছাড়াও টাঁকশাল, দেশের সব শিক্ষা বোর্ড, বিভিন্ন সরকারি সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতেও দেশীয় কাগজ ব্যবহূত হচ্ছে। শুধু দেশে নয় বিপিএমএর সদস্যভুক্ত মিলগুলোতে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাগজ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ কাগজ ও কাগজ জাতীয় পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। কাগজ জাতীয় পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ ছাড়া আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন করে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে এই শিল্প খাত জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সর্বশেষ খবর