সোমবার, ৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

মেহেরপুরে গাছদাদার গাছের গ্রাম

মাহবুবুল হক পোলেন, মেহেরপুর

মেহেরপুরে গাছদাদার গাছের গ্রাম

‘১৯৬০ সাল। তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। পাঠ্যপুস্তকে জানতে পারি— ছায়া যে দান করেন, তিনি ছায়া পান। এতেই প্রথম উদ্বুদ্ধ হই। ওই বছরই ১ মার্চ রাস্তার পাশে প্রথম একটা পাকুড় গাছ লাগিয়ে বনায়ন শুরু করি। পাকুড় গাছ বছরে ৪-৫ বার ফল দেয়। পাখিরা তা খায়। এই গাছ বড় হলে বিশাল আকৃতির হয়। ছায়া দেয়। রোদ, বৃষ্টিতে সেই ছায়ার মানুষজন আশ্রয় নেয়। তাছাড়া গাছ অক্সিজেন দেয়। যা প্রাণ রক্ষায় সাহায্য করে। তাই আজও গাছ লাগাই।’ কথাগুলো বলেছেন মেহেরপুরের বিস্তীর্ণ রাস্তা ও গ্রামে গাছ লাগিয়ে ‘গাছদাদা’ উপাধি পাওয়া আজিজুল হক। তিনি শিক্ষকতার বেতন ও নিজের ঝাড়ের বাঁশ দিয়ে ঝাপড়ি বানিয়ে গ্রামে গ্রামে গাছ লাগিয়েছেন। ’৯৭ সালে অবসর নিয়েছেন তিনি। এখন বয়স ৮০। তবুও গাছ লাগানো বন্ধ করেননি। গাছদাদা আজিজুল হক বলেন, ’৬০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিই। তখন গাছ লাগানো নেশায় রূপ নেয়। বনায়নের অর্থের জন্য ’৬১ সালে শিক্ষকতার চাকরি শুরু করি। তখন থেকে ’৯৭ পর্যন্ত পুরোমাত্রায় গাছ লাগিয়ে বেড়িয়েছি। আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে এবং মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কসহ গাংনী উপজেলার ২০-২৫ কিলোমিটার পথজুড়ে এই গাছ রয়েছে। তিনি বলেন, তখন সকালে ২-৩টি গাছ লাগিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল শেষ করে বিকাল পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে আবার গাছ লাগানো ও গাছের পরিচর্যা করে বেড়াতাম। গ্রামের এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে লাগানো গাছ নেই। তা ছাড়া শিক্ষকতার কারণে যে স্কুলেই বদলি হয়েছি, সেই স্কুলের সীমানাজুড়ে শত শত গাছ লাগিয়েছি। পরে ’৮০ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষণা দেন- রাস্তার পাশে যে বনায়ন করবে, সে ওই গাছের মালিক হবে।

এতে দ্বিতীয়বার উদ্বুদ্ধ হই আমি। শুরু করি রাস্তার দুই পাশে ১০ ফুট দূরত্বে ফলদ ও ঔষধি গাছ ব্যাপকহারে লাগানো। সেই গাছই এখন বড় হয়ে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের দুই পাশ ছায়ায় আচ্ছাদিত ও সুশোভিত করে রেখেছে। এক্ষেত্রে কাঁঠাল গাছ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা কাঁঠাল পুষ্টিকর ও জাতীয় ফল। কাঁঠালের কোনো কিছুই ফেলা যায় না। গাছে ফল দেওয়া শুরু হলে তা আশপাশের মানুষজন ভক্ষণ করে। তিনি আরও জানান, মানুষজন তার লাগানো গাছের ফল খান। ছায়া নেন। অক্সিজেন নেন। যা দেখে তিনি খুবই আনন্দ পান। এ কারণে এখন সবাই তাকে ‘গাছদাদা’ বলে ডাকেন। আজিজুল হক বলেন, প্রশান্তিতে আজ ৭৫ বছর বয়সে নিরোগ দেহ নিয়ে হেঁটে বেড়াই। খাওয়া স্বাভাবিক। খালি চোখে দেখি। আর গাছ লাগাই। জানা গেছে, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহারবাটি ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে বাড়ি হলেও আশপাশের ৩-৪টি গ্রামজুড়ে তার লাগানো হাজার হাজার গাছ আছে। এখনো তিনি নিড়ানি, কোদাল, মাথাল নিয়ে গাছের জন্য ছুটে বেড়ান। ছেলেমেয়েরা সবাই স্বাবলম্বী। তারা নিষেধ করেন এই কাজ করতে। কিন্তু দীর্ঘ নেশা তার পিছু ছাড়েনি। আজিজুল জানান, ’৬১ সালে এক টাকা পারিশ্রমিকে মনিষ (শ্রমিক) নিয়ে গাছ লাগানো ও পরিচর্যার কাজ করেছি। এখন সেই মনিষের হাজিরা ২২০ টাকা। তখন প্রতি ৬ ফুট লম্বা আম ও কাঁঠালের চারার মূল্য ছিল ৫ পয়সা। এখন সেই চারার দাম ২৫০ টাকা। তার শিক্ষকতার প্রথম বেতন ছিল ৩৫ টাকা। আইয়ুব খান আমলে ১০ টাকা বাড়লে তার গাছ লাগানোও বেড়ে যায়। নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী ধানখোলা, চিত্লা, বাগুন্দা, সাহারবাটি, খোকসা, মদনাডাঙ্গা গ্রামজুড়ে গাছ লাগান। গরু-ছাগল যেন গাছ মুড়িয়ে না খেতে পারে- সে জন্য তিনি গ্রামের এ মুল্লুক থেকে ওই মুল্লুক পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। তিনি বলেন, এখন চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। উপার্জন নেই। তাই বলে সন্তানদের দ্বারস্থ হই না। পেনশনের টাকা দিয়ে এখনো গাছ লাগাই। তবে সাইকেল চালিয়ে আর পরিচর্যা করা সম্ভব হয় না। আগে প্রতিদিন ১০-১২টা গাছ লাগিয়েছি, এখন অন্তত প্রতিদিন একটা গাছ লাগাই। কারণ গাছ না থাকলে পরিবেশ, জীবজন্তু কিছুই থাকবে না।

সর্বশেষ খবর