মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

জিয়া বললেন, কনগ্রাচুলেশন ডালিম! ওয়েল ডান

জয়শ্রী ভাদুড়ী

জিয়া বললেন, কনগ্রাচুলেশন ডালিম! ওয়েল ডান

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ বলেছেন, তিনি ছাড়া সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন সবাই এই হত্যা ষড়যন্ত্র বিষয়ে জানতেন। কিন্তু তাকে কেউ-ই ব্যাপারটি জানাননি। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর ডালিমকে বলছিলেন, ‘কনগ্রাচুলেশন ডালিম! ওয়েল ডান’। ওই অভিনন্দন জানানো থেকে তিনি বুঝতে পারলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তার হাত আছে। জেনারেল শফিউল্লাহ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রবাহ তুলে শফিউল্লাহ বলেন, ‘১৫ আগস্ট ফজরের নামাজের পরপরই ডিরেক্টর অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (ডিএমআই) লে. কর্নেল সালাউদ্দিন আমার বাসায় এসে বললেন, ‘স্যার, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ট্যাংক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গেছে।’ তখন আমি ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়াতকে ব্যাটালিয়ন নিয়ে এগিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেনাসদস্যদের পোশাক দেখে আমার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই সবাইকে ফোন করলেও আমাকে করেননি। পরে খবর পেয়ে আমি তাকে ২০-২৫ বার ফোন করি। একবার ফোন রিসিভ করে তিনি বলেন, ‘শফিউল্লাহ, তোমার সৈন্যরা আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। কামালকে মনে হয় মেরেই ফেলেছে। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নাও। আমি তাকে বললাম, ‘স্যার, আপনি কি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ এরপর আমি লাইনে থাকলেও তিনি আর কোনো সাড়া দেননি। কিছুক্ষণ পর আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, মেজর শাফায়াতকে ফোন করার পর আমি জিয়া ও খালেদ মোশাররফকে ডাকি। শাফায়াতকে ফোনে নির্দেশনা দিলেও তখনো কোনো খোঁজ না পাওয়ায় আমি আমার অফিসে গেলাম। এর আগে খালেদ মোশাররফকে বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলি। এ সময় জিয়াও আমার সঙ্গে অফিসে আসেন। সকাল ছয়টার দিকে খবর পাই যে, বঙ্গবন্ধু আর নেই। এ সময় খালেদ মোশাররফ ফোন করে জানায়, তাকে ওরা আসতে দিচ্ছে না। আমি বলি, কারা আসতে দিচ্ছে না? কিন্তু খালেদ আর কোনো উত্তর দিলেন না। এর কিছুক্ষণ পর মেজর ডালিম কয়েকজন সেনাসদস্য নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় আমার অফিসে আসে। সে সরাসরি আমার রুমে ঢুকে খুব কাছে এসে অস্ত্র তাক করে বলে, ‘আপনাকে প্রেসিডেন্ট যেতে বলেছেন।’ তখন আমি বলি, ‘বঙ্গবন্ধু তো বেঁচে নেই। তাহলে তিনি আমায় কীভাবে ডেকে পাঠান।’ ডালিম বলে, ‘এখন খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট। তিনি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’ তখন আমি আমার দিকে তাক করা অস্ত্রের নলে হাত দিয়ে বলি, ‘এই অস্ত্র আমি দেখে এবং ব্যবহার করে অভ্যস্ত। কথা বলার জন্য এসে থাকলে অস্ত্র আর অন্য সেনাদের বাইরে রেখে এসো।’ সে বাইরে অস্ত্র রেখে এসে আমাকে যেতে বললে আমি বলি, ‘খন্দকার মোশতাক তোমার প্রেসিডেন্ট হতে পারে, আমার না। তোমরা যা পার করতে পার, আমি কোথাও যাব না।’ এ কথা বলে আমি তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাইরে এসে আমার গাড়িতে উঠতে যাই। ঠিক এ সময় পেছনে তাকিয়ে দেখি ডালিমকে জিয়াউর রহমান বলছেন, ‘কনগ্রাচুলেশন ডালিম! ওয়েল ডান।’ এ সময় তিনি আঙ্গুল দিয়ে নিজের গাল দেখিয়ে বলেছেন, ‘কিস মি। এসো, আমার গাড়িতে ওঠ।’ তখন ডালিম বলল, ‘না, আমি কোনো জেনারেলের গাড়িতে উঠব না। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।’ জিয়ার এই কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়ে যাই। তখনই আমার মনে হয় এর মধ্যে তার হাত আছে।’ খন্দকার মোশতাকের সরকার সমর্থনের ঘোষণার ব্যাপারে জানতে চাইলে শফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি ৪৬ ব্রিগেডের দিকে রওনা দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি সব কমান্ডার ব্যস্ত। আমার কথা শোনার মতো লোক নেই। এমন সময় তারা অস্ত্রের মুখে নৌবাহিনী প্রধান ও বিমান বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে এলো। আমাদের তিনজনের দিকে অস্ত্র তাক করে আমাদের রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখি সেখানে খন্দকার মোশতাক বসে আছে আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাহের উদ্দিন ঠাকুর। আমাদের পাশের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। সরকারকে সমর্থন দিয়েছি এরকম একটা লেখা নিয়ে এসে পড়তে বলল। ওই লেখা পড়তে আমাদের বাধ্য হয়েছিল। লেখাটা পড়লে সেটা রেকর্ড করে বেতারে প্রচার করেছে।  স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হবে কিনা এসব নিয়ে আলোচনা চলছিল। আমি তখন বঙ্গভবনে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারী কর্নেল রশিদ এসে আমার কাছে বসে। আমি ওকে বলি, ‘আচ্ছা রশিদ, বঙ্গবন্ধু হত্যার এই পরিকল্পনা আমি ছাড়া আর কে কে জানেন না। জবাবে সে বলে, ‘স্যার, আপনি ছাড়া সবাই জানেন। আমরা প্রথমে খালেদ মোশাররফ স্যারকে তার অফিসে গিয়ে বলেছিলাম। তিনি আমাদের গালিগালাজ করে অফিস থেকে বের করে দেন।’ তাহলে আমাকে বললে না কেন? জানতে চাইলাম আমি। রশিদ বলল- ‘স্যার, রোজার ঈদের পর অন্য সেনা অফিসারদের মতো আমিও সস্ত্রীক আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন আপনাকে বলতে চেয়েছি। কিন্তু সাহস পাইনি।’ শফিউল্লাহ বলেন, খালেদ মোশাররফ আর আমার অফিসের দূরত্ব ২০ গজের চেয়েও কম। অথচ তিনিও আমায় কিছুই জানাননি।

সর্বশেষ খবর