বুধবার, ৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

পরিবহনে মূল সমস্যা চাঁদাবাজি

সাঈদুর রহমান রিমন

পরিবহন সেক্টরের অরাজকতার মূলে রয়েছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। পরিবহন মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, রুট কমিটি, টার্মিনাল কমিটিসহ নানা সংগঠনের ব্যানারে প্রতি ট্রিপেই যানবাহনগুলো থেকে নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এর পরও আছে সড়ক-মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ নানা চক্রের চাঁদাবাজি। পুলিশসহ বিভিন্ন প্রশাসনের মাসহারার নামে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি চলছেই। এসব চাঁদাবাজির ধকল মেটাতে গিয়েই পরিবহন সেক্টর দিন দিনই নৈরাজ্যকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে পরিবহন শ্রমিক সংগঠন, মালিক সমিতি, প্রশাসনসহ সরকারের দায়িত্বশীল মহলের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন পরিবহনসংশ্লিষ্টরা। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য থামানোর সাধ্য যেন কারও নেই। রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এ চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। একশ্রেণির পরিবহনশ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহন চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। দিন দিনই চাঁদাবাজির এমনই বিস্তৃতি ঘটেছে যে, ইদানীং অলিগলির ১ কিলোমিটার সড়ককেও চাঁদাবাজির আওতায় নেওয়া হয়েছে।

সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পো, বাস, মিনিবাস, ট্রাক থেকে জোর করে টাকা আদায়ের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। সন্ত্রাসীরা সরাসরি ‘চাঁদা’ তুললেও পরিবহনশ্রমিকরা চাঁদা নেন শ্রমিককল্যাণের নামে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা টাকা তোলেন মাসহারা হিসেবে। এ ছাড়া আছে বেকার ভাতা, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের অবৈধ চার্জ। এমন নানা নামে, নানা কায়দায় চলছে চাঁদাবাজির ধকল। সায়েদাবাদ-গাবতলী রুটে চলাচলকারী একাধিক মিনিবাস চালক বলেন, নানামুখী চান্দা ধান্ধার কবলে পড়ে গাড়ির চালক, মালিক, শ্রমিক সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদসহ অন্যান্য বাস ও ট্রাক টার্মিনালের অবস্থা আরও দুর্বিষহ। এসব স্থানে গাড়ি ঢুকতেও টাকা লাগে, বেরোতেও লাগে। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে চলছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। রাজধানীর এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে ট্রাকপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা গুনতে হয়। ট্রাকচালকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আগে সাধারণত ঢাকার যে কোনো একজন সার্জেন্টকে ১০০ টাকা দিয়ে স্লিপ সংগ্রহ করলে সিটির মধ্যে আর কোথাও পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে এক সার্জেন্ট অন্য সার্জেন্টের স্লিপকে পাত্তা দেন না, আলাদাভাবেই টাকা দিতে হয়। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা জানান, সায়েদাবাদ থেকে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত ২ সহস্রাধিক যানবাহন থেকেই দৈনিক আদায় হচ্ছে ৩০ লক্ষাধিক টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস্রাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে। বাস-মিনিবাসের চালক ও শ্রমিকরা জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে টুঁশব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনালছাড়া হতে হয়। রাজধানী থেকে চলাচলকারী দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিদিন চাঁদা প্রদানের বিস্তারিত তালিকা তুলে জানান, পরিবহনসংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০, মালিক সমিতির ৮০, শ্রমিক ইউনিয়নের ৪০, টার্মিনাল কমিটির ২০, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০, কেরানির ভাতা ২০, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ ও একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পুলিশ। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এর প্রতিবাদ করলে হয়রানি আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন ৯০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। সড়ক বা মহাসড়কে এই ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে জানান রুস্তম আলী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার টেম্পো ও হিউম্যান হলার চলাচল করে। স্থানভেদে যাত্রী পরিবহনের জন্য এসব যান থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেম্পো বা হিউম্যান হলার থেকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি করা হয় মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, ফার্মগেট, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, জুরাইন রেলগেট, নিউমার্কেট, আজিমপুর, নিউ পল্টন, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মিরপুর মাজার রোড, উত্তরখান, দক্ষিণখান, উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টর থেকে মাজার রোড, জসীমউদ্দীন সড়কের মোড় থেকে দিয়াবাড়ী, হাউস বিল্ডিংয়ের মোড় থেকে দিয়াবাড়ী এলাকায়।

সর্বশেষ খবর