শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভারতে সোনা যায় বাংলাদেশ হয়ে

♦ যশোরে ৭৩ কেজি সোনাসহ আটক তিন ♦ ঠেকানো যাচ্ছে না কোনোভাবেই

সাখাওয়াত কাওসার

ভারতে সোনা যায় বাংলাদেশ হয়ে

গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে শার্শা উপজেলার শিকড়ি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভ্যানে করে সীমান্তের দিকে যাচ্ছিলেন সফুরা খাতুন ও ইসরাফিল নামের দুজন। এ সময় কর্তব্যরত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৪৯ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা তাদের গতিরোধ করলে তারা একটি ব্যাগ ফেলে পালানোর চেষ্টা করেন। ব্যাগ তল্লাশি করে ২ কেজি ওজনের ১১টি সোনার বার পাওয়া যায়। পরে ধাওয়া করে সফুরা ও ইসরাফিলকে আটক করে বিজিবি। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে আরও সোনা উদ্ধারে অব্যাহত থাকে বিজিবির অভিযান।

গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত সীমান্তবর্তী নারিকেলবাড়িয়া ও শিকড়ি থেকে মেলে আরও ৬২৪টি বার অর্থাৎ ৭৩ কেজি সোনা। আটক করা হয় শার্শা উপজেলার শিকারপুর গ্রামের তোজাম্মেল হোসেনের ছেলে মহিউদ্দিনকে। দুই দিনে ৭৫ কেজি সোনা উদ্ধার করে বিজিবি। বিজিবি ৪৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ আরিফুল হক বলেন, ভারতে পাচারের সময় পৃথক অভিযান চালিয়ে ৭৪ কেজি ৭৫৯ গ্রাম ওজনের ৬৩৬টি সোনার বারসহ তিন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। তারা সোনা পাচারের বাহক হিসেবে কাজ করছিলেন।

এদিকে ঠিক আগের দিন বুধবার রাতে শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গ্রিন চ্যানেল পার হওয়ার সময় সোয়া ১২ কেজি সোনাসহ আরশাদ আয়াজ আহমেদ নামের ভারতীয় এক নাগরিককে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস (ডিসিএইচ)। ওই যাত্রী ব্যাংকক থেকে থাই এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে (টিজি-৩৩৯) ঢাকায় আসেন। তার কোমরে সাদা স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় ১২ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ২২টি সোনার বার পান কাস্টমস কর্মকর্তারা; যার আনুমানিক মূল্য ৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। আরশাদের বাড়ি ভারতের কলকাতায়।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না সোনা চোরাচালান। ক্রমে যেন তা বেড়েই চলেছে। আর সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে চলছে এ কর্মকাণ্ড। মাঝে মাঝে কিছু কিছু চালান ধরা পড়লেও বেশির ভাগ চালান নিরাপদে পার হয়ে চলে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সোনা বহনকারীদের দু-এক জন ধরা পড়লেও আড়ালে থেকে যাচ্ছেন মাফিয়া-গডফাদাররা। ওয়াকিবহাল সূত্র বলছেন, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ভারত সোনা আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার পর চোরাপথে সোনা আমদানি বেড়ে যায় হু হু করে। এজন্য অত্যধিক মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ৪ হাজার কিলোমিটারের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। দিন দিন সোনা পাচারের সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ট্রানজিট রুট হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। আকাশপথে আসা সোনাগুলো বাস ও ট্রেনে করে সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, যশোর, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী দিয়ে পাচার হচ্ছে। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার কেজি সোনার চাহিদা রয়েছে। দৈনিক চাহিদা ৩ হাজার ৮৯৭ কেজি। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কেজি সোনা পাচার হয়। সোনা চোরাচালান বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মো. শহিদুল ইসলাম জানান, ‘চোরাপথে আসা বেশির ভাগ সোনা ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সীমান্ত এলাকা যশোরের বেনাপোল ও দর্শনার জয়নগর থেকে মাঝে মাঝেই উদ্ধার হচ্ছে সোনা। আমরা আমাদের নজরদারিও বাড়িয়েছি।’ নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছেন, সোনা পাচারে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে দুই বাংলায় শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সক্রিয় এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সোনা ভারতে পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিরাপদ ও প্রধান ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে সোনা চোরাকারবারিরা। অবৈধ পাচার প্রতিরোধ বা ঠেকাতে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে সোনার ওপর আমদানি শুল্ক ২০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এর পরও থামানো সম্ভব হচ্ছে না সোনা পাচার। বিমানবন্দরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার পরও সোনা আসছে দেদার। প্রায় প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহেই ধরা পড়ছে ছোট-বড় চালান। গোয়েন্দাসূত্র বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে ৬৮টি করিডর রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ১৪৯টি চোরাচালানের জন্য স্পর্শকাতর গ্রাম। চর এলাকা হলো পাচারের জন্য সুবিধাজনক। বিশেষ করে বর্ষাকালে এসব স্থানে সীমান্ত পাহারা খুবই কঠিন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অস্ত্র, মাদক, সোনা ও বিস্ফোরক চোরাচালানের বহু সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যাদের আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এখনই যদি এদের নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে দ্রুত এ অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে অপরাধ নিয়ন্ত্রকদের আরও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নইলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম বলেন, সোনা চোরাচালানের অনেক সিন্ডিকেট পরিবর্তন হয়েছে। আগে ঢাকা এয়ারপোর্ট দিয়ে বেশি চালান এলেও বর্তমানে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট দিয়েই বেশি চালান আসছে। এসব চোরাচালানের সঙ্গে বিমান ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের লোকজন জড়িত। প্রসঙ্গত, গত ৬ আগস্ট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাতার এয়ারলাইনসের একটি বিমানের সিটের নিচ থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার সোনা জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এর আগে ২৯ জুলাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় তলার এয়ার লাউঞ্জের মসজিদ থেকে সিভিল অ্যাভিয়েশনের ক্লিনার জামাল উদ্দিন ও দুজন যাত্রীসহ ৬ কেজি ৬৩ গ্রাম ওজনের ৫৭টি সোনার বার উদ্ধার করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এর আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অন্য দুই যাত্রী হলেন মোহাম্মদ একরামুল হক ও জাহিদুল হক সালমান ভূঁইয়া।

সর্বশেষ খবর