শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

নিরাময় কেন্দ্রে অনিশ্চিত নিরাময়

মির্জা মেহেদী তমাল

নিরাময় কেন্দ্রে অনিশ্চিত নিরাময়

কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিপন। ভালো ছবি আঁকেন। সহপাঠীদের সঙ্গে মজা করতে করতেই হঠাৎই জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা সেবনে। ছয় মাসের মাথায় পূর্ণআসক্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনার পর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে রাজধানীর একটি নামকরা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। সেখানে তিন মাসের ‘প্যাকেজ’-এ চিকিৎসা শেষ করেও আরও বাড়তি দুই মাস চিকিৎসা নেন তিনি। এরপর নিরাময় হয়েছে বলে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই অভিভাবকরা টের পান, রিপন আসলে ইয়াবা সেবনে আবারও জড়িয়ে পড়েছেন। কয়েক ধাপে তাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এদিকে, সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেও রিপন পিছিয়ে পড়েন। বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রিপন নিজেই বুঝতে পারেন, মাদক ছাড়তে হবে। স্ব-উদ্যোগে চেষ্টা করেন রিপন। ছবি আঁকাতে সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন। কাজের মধ্যেই মুক্তি পেতে চান রিপন। কিন্তু কিছুতেই পারেন না মাদক ছাড়তে। একসময় তিনি বুঝতে পারেন, এভাবে মাদক ছাড়তে পারবেন না। মাদক সেবন আর করতে না চাইলেও শরীরের চাহিদা ও মনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পান না রিপন। ঘুরেফিরে সেই মাদকের আখড়ায় তাকে যেতে হচ্ছে। তাহলে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র কী করলে মাদক ছাড়া যাবে? এমন প্রশ্ন তার মনেও জেগেছে। রিপনের পরিবারের বক্তব্য, কিছু ভালো কথা বললেই মাদক সেবন থেকে সরানো সম্ভব নয়। তাদের উপযোগী নানা ধরনের কাজে নিয়োগ করতে হবে। যা মাদক দ্রব্য নিরাময় কেন্দ্রগুলো করছে না। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে যে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে, সেগুলোয় কাউন্সেলিংটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দক্ষ কাউন্সিলরের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাও হচ্ছে না। বরং তিন মাসের প্যাকেজের হিসাব দেখিয়ে মাদকাসক্তদের অভিভাবকের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা নেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন সম্পর্কে অভিভাবকরা জানতে চাইলে, আসক্ত ব্যক্তির মানসিক শক্তি বাড়ানোটাই পুনর্বাসন বলে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

দেশে মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্ত পরামর্শ কেন্দ্র, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ৬৮টি। তবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেবল ঢাকা শহরেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে সহস াধিক। লাইসেন্সপ্রাপ্তদের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনার কয়েকটি কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, চড়া দামে নিরাময়ের আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত এমন উদাহরণ পাওয়া দায়। রাজধানীর বেশির ভাগ নিরাময় কেন্দ্র অপরিষ্কার ঘিঞ্জি পরিবেশ। তিন মাসে নিরাময় হয় বলে রোগীদের বলা হলেও কয়েক মাস বেশি সময় নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে থাকে। প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা খরচ বাবদ ধরা হয়। কিন্তু এরা জানে না, কত শতাংশ মাদকাসক্ত  নিরাময় সম্ভব হয়েছে।

মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোড, মোহাম্মদী হাউজিং, রায়ের বাজার, উত্তরা, গ্রিনরোড, এলিফ্যান্ট রোডের  বারাক, মনোচিকিৎসালয়, জীবনের ঠিকানা, আশার আলো সেবা, রি-লাইফ, মুক্তি ক্লিনিকের অবস্থাও একইরকম। উত্তর শাহজাহানপুরে মাদকাসক্তি নিরাময় ক্লিনিক নাম দিয়ে একটি নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও সেখানে নেই কোনো সাইনবোর্ড। চারজন ব্যক্তি একটা তিন তলা ফ্ল্যাট বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে এটি পরিচালনা করেন। একাধিকবার তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। দেশে যথেচ্ছভাবে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে ওঠার অভিযোগ আছে। ফলে বিধিমালা ও শর্তগুলো অনেকাংশেই উপেক্ষিত। বেশির ভাগ কেন্দ্রেই চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সিলর নেই। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা অনুপস্থিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, মাদকাসক্তি নিরাময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা হওয়া উচিত। মাদক পরিবার ও সমাজ থেকেও দূরে ঠেলে দেয় এই আসক্তদের। একসময় তারা পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই অভিশপ্ত জীবন থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার একটি বড় সহায় মাদক নিরাময় প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৮ সালের আগস্টে ঢাকায় ৪০ শয্যার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করে সরকার। বর্তমানে ঢাকার বাইরে রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ৫ শয্যার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে। রাজধানীসহ সারা দেশে বেসরকারি উদ্যোগে বর্তমানে ১৮৮টি মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের।

সর্বশেষ খবর