রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছদ্মবেশে পাশাপাশি

মির্জা মেহেদী তমাল

ছদ্মবেশে পাশাপাশি

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কামাল হোসেন। তিন দিন আগে তিনি বাসে করে যাত্রাবাড়ী যান। গুলিস্তানে আসার পর  বাসের ভিতরেই এক বিক্রেতার কাছ থেকে তিনি ঝালমুড়ি কিনে খান। এরপর তার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে তিনি নিজেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে দেখতে পান। জানতে পারেন, যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডের রাস্তার ওপর তিনি পড়ে ছিলেন। লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার পকেটে টাকা ও মোবাইল ফোন সেট ছিল। সেগুলো পাওয়া যায়নি।

একই দিন বিকালে গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের সামনের সড়কে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন মোকছুদ (৬০) নামে এক ব্যক্তি। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঠিক একই সময় গুলিস্তান পুলিশ বক্সের সামনে মেঘনা পরিবহনে ফরহাদ (৩৫) নামে একজনকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মামুন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কে ঢাকা-গাবতলী রুটের একটি বাস থেকে অচেতন অবস্থায় ছিদ্দিক আলীকে (৭৫) উদ্ধার করা হয়। এক দিনেই ঢামেক হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় আরও চার ব্যক্তিকে ভর্তি করা হয়। পথ চলতে এরা প্রত্যেকেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন। খুইয়েছেন নগদ টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী। এদের একজনের জ্ঞান ফিরে ৪৮ ঘণ্টা পর। এর কিছুদিন আগে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে পাঁচ লাখ টাকা খুইয়েছেন তিন গরু ব্যবসায়ী। আশপাশে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর অজ্ঞান পার্টি। ভয়ঙ্কর এই পার্টির সদস্যরা কখনো ঝালমুড়িওয়ালা, কখনো ডাব, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, ক্রিমজাতীয় বিস্কুট, চকোলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি বিক্রেতার ছদ্মবেশ নিয়ে শ্বাস ছাড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ের ওপর। টার্গেট করা ব্যক্তিকে অজ্ঞান করে লুটে নিচ্ছে টাকা ও মালামাল। তাদের তৎপরতা বেড়েছে আসন্ন কোরবানির ঈদ সামনে রেখে। এই মৌসুমে তাদের নিশানায় থাকে গরু ব্যবসায়ী। প্রতি বছর কোরবানির পশুরহাটে এই ভয়ঙ্কর চক্রের তৎপরতা বাড়ে। সারা দেশে কয়েকশ গরু ব্যবসায়ী তাদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে। এবারও তাদের তৎপরতা বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় এক দিনে সাতজনের অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাটি ভয়ঙ্কর বিষয়। এটি তাদের টেস্ট কেস বলেও মনে করছে গোয়েন্দারা।

গতকাল পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত এক বৈঠকে এ বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী পুলিশ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জনগণের সার্বিক সহায়তা ও সচেতনতা কামনা করে বলেন, অপরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে পানীয় এবং খাবার গ্রহণ করবেন না। বড় ধরনের আর্থিক  লেনদেনের ক্ষেত্রে পুলিশের সহায়তা নেবেন। অজ্ঞান ও মলম পার্টির অপতৎপরতা থেকে সতর্ক থাকবেন। প্রয়োজনে লিফলেট ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস, লঞ্চ, ট্রেন স্টেশন ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অচেতন ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হচ্ছে। এদের বেশির ভাগই ঢামেক, মিটফোর্ড,  সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে তা খুবই বিপজ্জনক। এসব ওষুধের প্রতিক্রিয়া মানুষের জীবন-মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি অনেকের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাও দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর প্রায় ২০টি পয়েন্টে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের বেশির ভাগই মৌসুমি অজ্ঞান পার্টির সদস্য। কয়েকটি চক্রকে চিহ্নিত করতে পারলেও তাদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।

পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, কোমলপানীয় কিংবা  বোতলজাত খাবার পানির সঙ্গে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহূত ইনসুলিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় অজ্ঞান করার  রেসিপি। আবার গণপরিবহনে সিটের কাছে ক্লোরোফোম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করার কাজটি করা হয়। ঈদ সামনে রেখে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এলাকা ভাগ করে ‘অপারেশন’ পরিচালনা করছে। ঘটনা সূত্রে দেখা গেছে, অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তারা একটি এলাকা থেকে বাস বা অন্য কোনো গণপরিবহনে উঠেছেন। সেখানে তাদের নিত্যনতুন কৌশলে অজ্ঞান করা হয়েছে। মাওয়া থেকে গুলিস্তান-সায়েদাবাদ রুট, কাঁচপুর-নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান, গাজীপুর থেকে আবদুল্লাহপুর, মহাখালী ও সাভার থেকে গাবতলী, মিরপুর ও চিড়িয়াখানা রুটের বাসগুলোতে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা  বেশি সক্রিয়। এ ছাড়া পল্টন, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে চক্রটি কাজ করছে। তবে কোরবানি পশুরহাটে এদের তৎপরতা বেশি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর