মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

মহাসড়কে শৃঙ্খলায় দুর্ঘটনা কমবে ৩০ ভাগ

শিমুল মাহমুদ

মহাসড়কে শৃঙ্খলায় দুর্ঘটনা কমবে ৩০ ভাগ

দেশের সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরানো গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩০ শতাংশ কমে যাবে বলে করেন সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। মহাসড়কে যানবাহনের বেপরোয়া গতি, স্বল্পগতির অবৈধ থ্রি হুইলার চলাচল, উল্টোপথের যানবাহন, মহাসড়কজুড়ে হাটবাজারসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনার অন্তত ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা যাবে। তাদের মতে, জাতীয় মহাসড়কগুলোয় অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ঘটনা, যানজট, যাত্রীদুর্ভোগ রোধ করা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, দাউদকান্দি, কুমিল্লা অংশে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান অবাধে চলাচল করছে। এসব স্থানে হুট করে উল্টোপথে রিকশা, ভ্যান চলে আসে। ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি গতিতে যখন একটি দ্রুতগামী যান চলে তখন চাইলেই তার গতি কমিয়ে আনা যায় না। নগর পরিবহনের একজন গবেষক বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ বলে সড়কে কান্নাকাটি করলেও সড়ক নিরাপদ হবে না। কারণ, সড়ক নিরাপদ করতে চাইলে সমস্যার মূলে ফোকাস করতে হবে। চালকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, তাদের জীবনমান উন্নয়ন ও সড়ক পরিবেশ উন্নত করতে হবে। বর্তমানে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দিনে গড়ে সাড়ে নয়জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ সংখ্যাটা ১০ বছর আগের তুলনায় কিছুটা কম। তবে এই ১০ বছরে সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। দুর্ঘটনা কিছুটা কমলেও নিরাপত্তায় আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

এদিকে সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলছে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার। কখনো কখনো উল্টোপথেও চলছে এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন। এজন্য ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা বাড়ছে। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট দেশের ২২টি মহাসড়কে সব ধরনের থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। কিছুদিন সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও অল্প সময়ের মধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরে যায় সবকিছু। মহাসড়কগুলোয় অবাধে চলতে শুরু করে ঝুঁকিপূর্ণ থ্রি-হুইলার, নসিমন, করিমন, রিকশা ও ভ্যান। ফলে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েই চলেছে।

ভুক্তভোগীদের মতে, স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এবং কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাচ্ছে না। এজন্যই ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের কোনো সুবিধা মিলছে না।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের জন্য বার বার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। হাই কোর্টও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু মহাসড়কে এসব ছোট যানবাহন কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। আগে মহাসড়কে শুধু সিএনজি অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ ব্যটারিচালিত থ্রি-হুইলার চলত। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য মোটরচালিত রিকশা। এগুলোর আবার চলার কোনো গতিপথ নেই। কখনো সোজা পথে চলে কখনো চলে উল্টো। এতে ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা দুটোই বাড়ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের কিছু কার্যক্রম ইতিবাচক ফল দিয়েছে। একসময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ককে দুর্ঘটনার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ সড়কে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটত। এ সড়কসহ দেশের ১৪৪টি চিহ্নিত দুর্ঘটনাপ্রবণ ব্ল্যাক স্পট নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায় দুর্ঘটনা অনেক কমেছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনা এখন অনেক কমে এসেছে।

সড়ক দুর্ঘটনার মতো জাতীয় সমস্যাটি স্বীকার করে সরকার জাতিসংঘের অন্য সদস্য দেশগুলোর মতো অঙ্গীকার করেছে, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে কাজ করবে। সেই অঙ্গীকার পূরণের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর পদক্ষেপ এখনো যথেষ্ট নয়। ফলে দুর্ঘটনাও তেমন একটা কমেনি।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা, জরুরি ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতাও দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে দায়ী।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সোহাগ পরিবহনের এক চালক বলেন, মহাসড়কে নিষিদ্ধ থ্রি হুইলারগুলো বন্ধ করতে না পারলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। চার লেনের মহাসড়কে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ৪ ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু সেখানে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টাও লেগে যায়। মহাসড়কের গৌরীপুর অংশে লোকাল বাস, থ্রি-হুইলার দাঁড়ানোর কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের থ্রি-হুইলারগুলো সুযোগ পেলেই পৌরসভা এলাকার মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে। জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার ১০০ কিলোমিটার এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে কুমিল্লার ময়নামতি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় নিয়মিত অটোরিকশা চলাচল করে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড ও সুয়াগাজী, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজার, আদর্শ সদর উপজেলার নন্দনপুর, আলেখাঁরচর ও ময়নামতি সেনানিবাস এবং বুড়িচং উপজেলার সাহেববাজার এলাকায় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ে হাজার হাজার সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। অন্যদিকে, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে নির্বিঘ্নে থ্রি-হুইলার চলাচল করে। এসব কম গতির যানবাহনের কারণে যানজটসহ নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। এদিকে মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও যানজট রোধে হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কে যান চলাচল নির্বিঘ্ন করার চেয়ে নিরিবিলি নির্দিষ্ট স্পটে দাঁড়িয়ে চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৩০০ জনবল নিয়ে হাইওয়ে পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

সূত্র জানায়, দেশের প্রায় ৩ হাজার ৬৫৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে ১ হাজার ৯৭৭ কিলোমিটার বা ৫৪ শতাংশ সড়কেই নিয়মিত নসিমন, করিমনসহ অবৈধ থ্রি-হুইলার চলাচল করে। এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে পারলে মহাসড়কে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।

সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দীন বলেন, মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, সড়ক পরিবেশ উন্নত করতে না পারলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। এজন্য পুলিশ, প্রশাসন, মন্ত্রণালয় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর