বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেই প্রতিরোধযোদ্ধারা এখন

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারীদের জীবন চলছে কষ্ট যন্ত্রণায়, ধু্ঁকে ধুঁকে

সাঈদুর রহমান রিমন

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পরপরই অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জীবন চলছে সীমাহীন কষ্ট-যন্ত্রণায়, অনাহারে, অর্ধাহারে। আছে পদে পদে অবহেলা-বঞ্চনা। কষ্টের জগদ্দল পাথর চাপাপড়া ‘মুজিবভক্তদের’ দীর্ঘশ্বাসই হয়ে উঠেছে একমাত্র সম্বল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সেদিনের যে দামাল ছেলেরা সশস্ত্র প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন, তারা কেউ ভালো নেই। অধিকাংশ যোদ্ধাই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। গত আট বছরে অভাব-যন্ত্রণায় ভুগে, বিনা চিকিৎসায় ৪৩ জন প্রতিরোধযোদ্ধার করুণ মৃত্যু হয়েছে, এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও অর্ধশতাধিক বীরযোদ্ধা। কোনো রকম চিকিৎসা-সুবিধা তাদের ভাগ্যে জুটছে না। অনেক প্রতিরোধযোদ্ধা বাড়িঘর হারিয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় অমানবিক জীবনযাপন করছেন। দুই বেলা খাবার জোটানোই তাদের জন্য কষ্টকর। গত চার দশকেও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। এমন ক্ষোভ আর যন্ত্রণাদগ্ধ কান্নার বিলাপ ফুটে উঠছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মুখে মুখে। প্রতিরোধযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে বার বার ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গেরিলা কমান্ডার জিতেন্দ্র ভৌমিক বলেন, পিতার (বঙ্গবন্ধু) রক্তের বদলা নিতে ছেলেদের যা করণীয় তা-ই করেছি। যে কারণে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিতেও ঘৃণাবোধ করেছি। অসমাপ্ত প্রতিরোধযুদ্ধের পর থেকেই টানা ৩৭টি বছর আসামের বিভিন্ন স্থানে নির্বাসনে ছিলেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে বাবা গজেন্দ্র ভৌমিক প্রশাসনিক নির্যাতনে রোগে শোকে মারা যান। মা চিত্র ভৌমিক এখনো বেঁচে আছেন প্যারালাইজড অবস্থায়। জিতেন্দ্র ভৌমিক চোখের কোণে জমে ওঠা পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি সেই সব সন্তানতুল্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলছি, মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছি তাদের। বলি, কাল যাব ঢাকায়, পরশু যাব ঢাকায়। সব জানাব জায়গা মতো। একটা কিছু করবই। একটা কিছু হবেই হবে।’ কিন্তু সেই একটা কিছু আর করা হয়ে ওঠে না জিতেন্দ্র ভৌমিকের, তাই তো নিজেই অনেকটা গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে থাকেন বিরিশিরি এলাকায়। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মুখোমুখি হলে খুবই ব্যস্ততার ভান ধরে তিনি এড়িয়ে যান। জিতেন ভৌমিক ক্ষোভে দুঃখে বলে ওঠেন, ‘আর পারছি না, ভাবছি নিজেই আবার ভারতে পালিয়ে যাব।’

পঁচাত্তরে প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে ভবানীপুর যুদ্ধঘাঁটিতে স্থাপিত হাসপাতালে নার্স-কাম-চিকিৎসকের দায়িত্বে ছিলেন বারোমারী গ্রামের সূচনা ম্রং। তিনি এখন অন্যের জমিতে কামলা খেটে সীমাহীন কষ্টে দুই মুঠো খাবার জোটান। নিজের আশ্রয় ভিটে থেকে তাড়িয়ে দেওয়ায় স্বামী-সন্তান নিয়ে সূচনার ঠাঁই হয়েছে অন্যের জমিতে। অমানবিক জীবনযাপনের কথা বলতে গিয়ে সূচনা বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন। সূচনা ম্রংয়ের স্বামী শেখর হাগিদকও প্রতিরোধযোদ্ধা হিসেবে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। একের পর এক থানা ও বিডিআর ক্যাম্প দখল করে শেখর ও তার সহযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বজুড়ে। কিন্তু প্রতিরোধযুদ্ধের পর নিজ গ্রামে ফিরে শেখর দেখতে পান খুনি মোশতাকচক্রের পক্ষে মিছিলকারীরা তাদের ধান, চাল, বাড়িঘর, সহায় সম্পদ সব কিছুই লুটে নিয়েছে। প্রায় ২০০ একর জায়গা-জমির মালিক শেখর হাগিদক রাতারাতি নিঃস্ব হলেন, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও থাকেনি তার। শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়েই গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তিনি পাড়ি জমান মেঘালয়ে, নির্বাসনে। কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে এসে আরও শোচনীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন তিনি। 

গোপালবাড়ির প্রতিরোধযোদ্ধা শহীন্দ্র হাজং মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে পেটের ভাত জোটাচ্ছেন। যারা বেঁচে আছেন তাদের দুর্দশা অবর্ণনীয়। মহেশখোলার ডা. মোস্তফা, আতানগরের দ্বীজেন সরকার, লেঙ্গুরার বিপিন গুণ, পেটেক মারাক, ভাটিপাড়ার কালিদাস, বারহাট্টার রায়মোহন সরকার, সুলতান নুরী, আবদুর রহমান, নাজিরপুরের মো. ফরিদ, দুর্গাপুরের আলেক চাঁনসহ বীরযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা করুণ মিনতি জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের জন্য কিছু একটা কমরন, আর তো বাঁচি না।’

পঁচাত্তরের অদম্য সাহসী বীরযোদ্ধা সাধন সরকার নিজের কঠিন ব্যাধির চিকিৎসা সহায়তার আর্তি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন। নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানা সদরে তার বাড়ি। কিন্তু কারও থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি। বিনা চিকিৎসা আর অর্ধাহারে-অনাহারে সাধন সরকার এরই মধ্যে মারা গেছেন। তার নাবালিকা দুটি মেয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় মানুষের দয়ায় কোনো মতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এতিম মেয়ে দুটি যেন অকুল পাথারে ভাসছে। তাদের কোথাও দাঁড়াবার মতো জায়গাও নেই।

সাহায্য-সহযোগিতার আশায় এখনো পথ চেয়ে থাকেন সীমাহীন অভাবগ্রস্ত শতাধিক প্রতিরোধযোদ্ধা। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনই ভুগছেন নানা রকম জটিল রোগে। চিকিৎসা, পথ্য দূরের কথা, নিজেদের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানার জন্য কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার উপায় নেই তাদের। নেত্রকোনা শহরের প্রতিরোধযোদ্ধা সাইয়েদুল কাদির ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় কয়েক মাস ধরেই ঘরে পড়ে আছেন। নেত্রকোনা শহরের নূর ইসলাম, গফরগাঁওয়ের ইসমাইল কমান্ডার, নেত্রকোনা বালীর খুর্শেদ আলী, বাহিরচাপড়ার নূরুজ্জামান খান, সুধারঞ্জন সরকার, ফিরোজ খান, মোস্তাফিজুর রহমানদের জীবন চলছে অভাব যন্ত্রণায় সীমাহীন কষ্টে। পঁচাত্তরের প্রতিরোধ ময়দানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী স্বপন চন্দ দীর্ঘদিন কিডনি ও আলসারের জটিল রোগে ভুগছেন। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সহযোগিতার আর্তি নিয়ে রাজধানীময় ঘুরে বেড়ান তিনি। স্বপন চন্দ বলেন, বিশেষ কিছু পাওয়ার আশায় আমরা প্রতিরোধযুদ্ধ করিনি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের আদর্শের পিতা, তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সন্তান হিসেবে যে দায়িত্ব ছিল সেটুকুই শুধু পালনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়া প্রতিরোধযোদ্ধারা ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে, অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে— এ দৃশ্য সহ্য করতে পারি না বলেই দ্বারে দ্বারে সাহায্য চাই। স্বপন চন্দ জানান, প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরিবারগুলোয় বেকারত্ব, অভাব আর কঠিন অসুখ-বিসুখের বেহালদশার নানা চিত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি অর্জন সম্ভব হয়। গত বছর অন্তত ৩০০ প্রতিরোধযোদ্ধার জন্য মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে অনুদান সহায়তাও বরাদ্দ দেন তিনি। কিন্তু নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের কিছু সদস্য সে সহায়তা পেলেও দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিরোধযোদ্ধা পরিবারগুলোতে তা পৌঁছেনি।

সর্বশেষ খবর