মঙ্গলবার, ২১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফেসবুকে ভয়ঙ্কর ফেক আইডি

মির্জা মেহেদী তমাল

ফেসবুকে ভয়ঙ্কর ফেক আইডি

রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সুরভি (ছদ্মনাম)। হঠাৎ একদিন তিনি ফেসবুকে নিজের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করা একটি আইডি দেখতে পান। তিনি সেই আইডি ভালো করে চেক করে দেখলেন। আইডি থেকে নিয়মিত অশ্লীল স্ট্যাটাস আপলোড করা হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন আইডিটা ফেক। তার ছবি আর তথ্য দিয়ে ভুয়া আইডি তৈরি করা হয়েছে। সুরভি এ ঘটনায় ভীষণ বিব্রতবোধ করছিলেন। অশ্লীলতার মাত্রা এতটাই ছিল যে তিনি শেষ পর্যন্ত পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্তে বের হয়ে আসে, ভুয়া ফেসবুক আইডিটি যিনি তৈরি করেছেন, তিনি তার একজন পুরুষ সহকর্মী। সুরভি বহুদিন পর্যন্ত জানতেই পারেননি, তার ছবি আর নাম ব্যবহার করে আপত্তিকর নানা কাজ করে যাচ্ছেন তারই এক পুরুষ সহকর্মী। কারমাইকেল কলেজ রংপুরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী শাকিলের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের এক ছাত্রীর। দীর্ঘদিন কথা হয় তাদের। তারা জড়িয়ে পড়েন প্রেমের সম্পর্কে। ভিডিও কলে কথা পর্যন্ত হয়েছে তাদের। এভাবে চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে শাকিলের থেকে টাকা ধার নিতেন মেয়েটি। টাকার পরিমাণটা ছিল অনেক কম— ২০০ থেকে ৫০০। আবার অনেক সময় টাকা ফেরতও দিতেন। এভাবে বছরখানেক যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন তারা। মেয়েটি তাকে মাসখানেক বাইরে থাকার মতো টাকা নিয়ে আসতে বলেন। শাকিল সেমতে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যান মেয়েটির কলেজে। কিন্তু না, বিয়ে তো দূরের কথা, শাকিলকে জিম্মি করে সব টাকা ও নিজের পরিশ্রমে কেনা মোবাইল ফোনটাও নিয়ে নেন মেয়েটি। শাকিল আর কোনো দিন খোলা পাননি তার নম্বর কিংবা ফেসবুক আইডি।

সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে ওই নারীর মতো প্রতিদিনই কেউ না কেউ অপরিচিত বা পরিচিতজনদের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। ফেসবুকে ফেক আইডি রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এখন ভয়ঙ্কর ফাঁদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে অপরাধীরা। ফেসবুকে ভুয়া তথ্য দিয়ে অনেকে মজা পেলেও প্রতারণার শিকার কেউ কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত পর্যন্ত হচ্ছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ফেসবুকই একদিকে যেমন বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট করছে, তেমন একে ব্যবহার করে কেউ কেউ স্বার্থ হাসিল করছে। প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে ফেসবুককে। প্রায়ই শোনা যায়, ফেসবুকে পরিচয় থেকে প্রেম। একসময় বন্ধুরূপী প্রতারকের খপ্পরে পড়ে অনেককে হারাতে হয়েছে ইজ্জত। শুধু তাই নয়, ইজ্জত খুইয়েই শেষ হয়নি, প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে অনেককে। আবার ফেসবুককে ব্যবহার করে বহু পরিবারকে করা হয়েছে ছন্নছাড়া। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে ব্যবহার করে প্রেমিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির কথা শোনা যায় হামেশা। আবার ফেক আইডি খুলে সম্মানি লোকের সম্মানহানি করা হচ্ছে অবলীলায়। ইদানীং অনলাইন কেনাকাটার নামেও হচ্ছে প্রতারণা। প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা জানাজানিও হচ্ছে। এর পরও মানুষ প্রতারকের খপ্পরে পড়ছে। আটকে যাচ্ছে প্রতারণার জালে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুকের যে আইডিগুলোয় ব্যবহারকারী তার নাম, পরিচয়, লিঙ্গ, ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য, কর্মক্ষেত্র, পড়াশোনার স্থানসহ কোনো কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে ভুয়া বা মিথ্যা তথ্য দেয়, সেগুলোকে ফেক আইডি বলা হয়। তথ্য ও যোগাযোগ খাতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) বলছে, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৬ লাখ। এর মধ্যে ১১ লাখই ভুয়া।

ভুয়া আইডি দিয়ে প্রতারণার বিষয়টি এখন এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) দ্বারস্থ হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্প্রতি প্রতারক চক্রের ১১ জন সদস্যকে নাটোরের লালপুর থেকে গ্রেফতার করে। এরা ভুয়া আইডি কার্ডে সুন্দরী নারীর ছবি লাগিয়ে যুবকদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কেউ কেউ প্রতারক চক্রের দ্বারা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। এই চক্রের সঙ্গে শুধু যুবক নয়, অনৈতিক কাজে জড়িত এমন যুবতীরাও জড়িত। বিশেষ করে প্রবাসী পুরুষদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে যুবতীদের দিয়ে ফোন করিয়ে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ভুয়া আইডিতে এরা সাধারণত নামের শেষে ‘আক্তার’ শব্দটি ব্যবহার করে। যেমন সোমা আক্তার, শেফালি আক্তার, রুপালি আক্তার, সালমা আক্তার, বিউটি আক্তার, খালেদা আক্তার, লায়লা আক্তার, সেলিনা অক্তার ইত্যাদি। এ ছাড়া নীল কষ্ট, হৃদয় ভাঙা মন, মন মানে না, কত যে কষ্ট এমন ধরনের নানা বাক্য ব্যবহার করে আইডিতে। এসব দেখলেই বুঝতে হবে প্রতারক চক্রের ভুয়া আইডি এটি। এই নিউজে যে মেয়েটির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে এই ছবিটি ভুয়া আইডিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই সাবধান হতে হবে এদের থেকে। ফেক ফেসবুক আইডি নিয়ে প্রায়ই বিড়ম্বনার শিকার হন বিভিন্ন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও অভিনয়শিল্পীরা। একজন অভিনেত্রী নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আমার নামে অন্তত ২০-২৫টি ফেসবুক আইডি খোলা হয়েছে। থানায় জিডি করেছি। র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করে ৮-১০টি আইডি বন্ধ করাতে পেরেছি। এর মধ্যে দুটো আইডিতে আমার ফোন নম্বর ব্যবহারসহ অশ্লীল কথাবার্তাও পোস্ট করা হয়। আমি ও আমার পরিবার ভীষণ সমস্যায় পড়ি এতে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ফেসবুকে ফেক আইডি খোলা ও অন্যকে প্রতারণা করাটা ব্যবহারকারীর খারাপ দিক; এটি ফেসবুকের খারাপ দিক নয়। ফেক আইডির বিড়ম্বনা থেকে স্বস্তি পেতে বন্ধুত্বের অনুরোধগুলো ভালো করে যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রয়েছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট। তারা অভিযোগ গ্রহণের পর সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আবার ফেসবুকে রয়েছে ‘সাইবার ক্রাইম ডিভিশন’ ফেসবুক পেজ। এ পেজের মাধ্যমেও অভিযোগ করা যাবে। সাইবার ক্রাইম ডিভিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, সংশোধিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারা লঙ্ঘন করলে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে। ১ কোটি টাকা জরিমানাও হতে পারে। কেউ ভুয়া আইডির কারণে প্রতারণার শিকার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যেতে পারেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর