শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

দালাল রাজ্য বিআরটিএ

সাঈদুর রহমান রিমন

দালাল রাজ্য বিআরটিএ

দালাল রাজ্যে পরিণত হয়েছে মিরপুর বিআরটিএ অফিস। সরকারি এ অফিসের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নানা কৌশলে দালালরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সেখানে গাড়ির লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা হস্তান্তর, ফিটনেস সার্টিফিকেটসহ যে কোনো কাগজপত্র সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকারি ফি জমা দেওয়ার আগে দালালি কমিশন পরিশোধ করাটাই রেওয়াজে পরিণত হয়ে আছে। এ কমিশনের মধ্যে কর্মকর্তাদের ঘুষের টাকাও লুকিয়ে থাকে। ঘুষ আর কমিশনের টাকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হলেই কেবল সরকারি ফি ব্যাংকে জমাদানের নির্দেশনা পাওয়া যায়। মিরপুর বিআরটিএর কোথায় নেই দালাল? কার্যালয়ে প্রবেশকালেই মূল ফটকের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ১০-১২ জন চিহ্নিত দালালকে আড্ডারত দেখতে পাওয়া যায়। বিআরটিএ অফিসে আগত সেবা প্রার্থীদের গাড়ি এলেই তারা চারপাশ ঘিরে ধরে, অল্প টাকায় কম সময়ের মধ্যেই চাহিদামাফিক সেবা দেওয়ার নানা প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে তারা। কার্যালয়ের ভিতরে বিভিন্ন কক্ষের আশপাশে, ব্যাংকে, বাদামতলায় সর্বত্র দালালরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো এ দালালদের মূল আস্তানা। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে দেখা যায়, দালালদের হাতে দিলে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ব্যাংকে ফি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও দালালদের অগ্রাধিকার, অথচ সাধারণ সেবাগ্রহীতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। সেবা নিতে আসা গুলশান শাহজাদপুর এলাকার আহসান আলী মোক্তার, মহাখালী দক্ষিণপাড়ার রুহুল আমীন, মুরাদ আহমেদ, তেজগাঁও নাখালপাড়া রেলগেটের ইনসুর আহমেদসহ কয়েকজন অভিযোগ করেন, সাধারণ প্রক্রিয়ায় সেবা পেতে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ দালালদের দিয়ে দ্রুত কাজ হয়ে যাচ্ছে। তারা জানান, কর্মকাণ্ডে দক্ষ ‘মাস্টার রোলের অস্থায়ী কর্মীদের হঠাৎ করেই সরিয়ে দিয়ে আনাড়ি অদক্ষ কর্মীরা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা ও সময়ক্ষেপণ ঘটাচ্ছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর কঠোর পদক্ষেপ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সতর্ক পাহারা, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান সত্ত্বেও বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়টি দালালমুক্ত করা গেল না। বরং বিআরটিএ ঘিরে দালালদের রমরমা বাণিজ্য দিন দিনই ফুলে-ফেঁপে আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও মন্ত্রিসভায় সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া অনুমোদন হওয়ায় গাড়ির নিবন্ধন, রুট পারমিট, নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নবায়নের সংখ্যা শতগুণ বেড়ে গেছে। বিআরটিএ অফিসের সামনের সড়কে ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। বেশির ভাগই প্রাইভেট কার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি। এ ছাড়া ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা তো থাকছেই। নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আসা লোকজনের ভিড় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে কাজের চাপ-তাই দালালদের ছোটাছুটিরও অন্ত নেই।

যানবাহন সংক্রান্ত বাড়তি কাজের চাপ সামাল দিতে বহিরাগত শতাধিক দালালের আওতায় অতিসম্প্রতি আরও প্রায় আড়াইশ সহকারী দালাল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কার্যালয়টির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই। বিআরটিএর দালালি তৎপরতা নির্বিঘ্ন রাখাসহ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারাও মাসিক বেতনে অর্ধশতাধিক      কর্মচারী নিয়োগ করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের স্বজন-পরিজনদের নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমেই গাড়ির যাবতীয় কাগজপত্র সম্পাদনের দালালি বাণিজ্য চলছে দেদার। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা বিআরটিএ আঙিনায় ‘দালালমুক্ত পরিবেশ’ প্রদর্শন করলেও এর আড়ালেই চলছে শুভঙ্করের ফাঁকিবাজি। বহিরাগত দালাল, সহকারী দালাল এবং আনসারদের নিয়োগকৃত প্রাইভেট কর্মচারীরা বিআরটিএ গেটের বাইরেই সেবা প্রার্থীদের ঘিরে ধরছেন, সেখানেই দরদাম মিটিয়ে গাড়ির প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদনের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন। গ্রাহকের কাছ থেকে গাড়ির কাগজপত্রাদি বুঝে নিয়ে দালালরা বিআরটিএ কার্যালয় ঘেঁষা গলির দোকানসমূহে তা জমা রাখেন। কিছুক্ষণ পর পরই আনসার সদস্যরা সেসব দোকানে দালালদের জমা রাখা কাগজপত্র সংগ্রহ করে তা বিআরটিএ কার্যালয়ের নির্দিষ্ট শাখা-টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছেন।

 এসব কাগজপত্রের স্ট্যাপলার পিনে আটকানো খামের ভিতরেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কর্মকর্তাদের চাহিদামাফিক সালামির টাকাও। যথারীতি ফাইলিং করে কাজ সম্পাদন শেষে আনসারদের হাত ঘুরে একই কায়দায় গাড়ির ফিটনেস, লাইসেন্স কিংবা নবায়ন পেপারস পৌঁছে যাচ্ছে দালালদের কাছে। ফলে অভ্যাগতরা সাদা চোখে বিআরটিএ কার্যালয়সহ গোটা আঙিনায় দালালমুক্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ দেখেই মুগ্ধ হচ্ছেন, কিন্তু নিজ হাতে গাড়ির কাগজপত্র সম্পাদন করতে গেলেই সীমাহীন ভোগান্তির মুখে পড়ছেন। নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, বেকায়দা ফাঁদে ফেলে সেবা প্রার্থীদের স্বেচ্ছায় বহিরাগত দালালদের কাছে যেতেই বাধ্য করা হচ্ছে। অভিনব কৌশলে আলাদা মোড়কে বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ের রমরমা দালালি বাণিজ্য আরও বেশি জমে উঠেছে। দালালমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির নানা উদ্যোগ আয়োজন সত্ত্বেও দালালরাই এখনো সেখানে সর্বেসর্বা, অপ্রতিরোধ্য। এদের বিরুদ্ধে খোদ মন্ত্রীও কয়েক দফা অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, বদলাচ্ছে না বিআরটিএর দালাল দৌরাত্ম্য।

দালালিতে জড়িত থাকার অপরাধে থানা-জেলহাজত খেটে আসা আবদুল মালেক জানান, এখন আনসার সদস্যরাই কেবলমাত্র বিআরটিএর দালালিতে নিয়োজিত রয়েছে। দালালরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাজ জুটিয়ে আনসারদের হাতে দেয়-বিনিময়ে ভিক্ষার মতো কিছু পায়।

প্রধান গেটের বাম পাশেই দেওয়া হচ্ছে তথ্য সেবা ও লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স। কিন্তু ২০০ টাকা না দিলে তা পেতে কত রকম যে হয়রানি পোহাতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝার উপায় নেই। তার পাশেই দেওয়া হচ্ছে ডিজিটাল নম্বর-প্লেট প্রদান শাখা। সেখানেও আছে ৫০০ টাকার ধান্দা, দালালদের ভাষায় এটা ‘ফিক্সড টাকা’। এ টাকা না দিলে নম্বর-প্লেট যে কতদিনে মিলবে তার ইয়ত্তা নেই। নম্বর-প্লেট লাগাতে ব্যস্ত ব্যক্তিটির পাশেই একটি ব্যাগে নম্বর-প্লেট লাগানোর ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই কিশোর। তাদের হাতে ২০০ টাকা না দিলে কোনোভাবেই লাগানো সম্ভব হয় না নম্বর-প্লেট। এক নম্বর ভবনের নিচে যেতেই দেখা যায় লোকজনের ভিড় ভাড়াক্কায় পা ফেলার তিল পরিমাণ জায়গাও যেন নেই। সেখানে দুই-আড়াই ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও ছবি তোলার সিরিয়াল মেলে না। তবে পাশেই দায়িত্বরত আনসার সদস্য রবিউলের হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই ছবি তোলা সম্পন্ন হয়ে যায়। বিআরটিএর সব শাখায় সব কাজেই সংশ্লিষ্ট আনসার সদস্যকে খুঁজে বের করতে পারলেই কাজ হাসিল। হয়রানি ভোগান্তি ছাড়াই টাকার বিনিময়ে প্রায় অলৌকিকভাবে চাহিদামাফিক কাজ সম্পাদন হয়ে যায়।

লাইসেন্স নিতে কীভাবে কোন কোন পর্যায়ে এই ঘুষ দিতে হয় এর খোঁজ নিতে গেলে সেবা গ্রহীতা পল্লবীর আইনুল মিয়া ও মোবারক হোসেনের কাছ থেকে জানা যায়, একটি লাইসেন্স নিতে গেলে কমপক্ষে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। দালালের মাধ্যমে নেওয়া ঘুষ ভাগ-বাটোয়ারা হয় সংশ্লিষ্ট শাখার কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে পুনঃপরীক্ষার জন্য দিতে হয় কমবেশি তিন হাজার টাকা। পেশাদার লাইসেন্সের পুলিশ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পেতেও ঘুষ লাগে। পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ স্টেশনে তদন্তের জন্য গেলে তা তদন্ত শেষে পুলিশের বিশেষ শাখায় ও পরে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এই তদন্ত প্রতিবেদন মাসের পর মাস খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘুষ না দিলে এ ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে উপ-পরিচালক (প্রকৌশল) মো. মাসুদ আলম জানান, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে দফায় দফায় শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে এখন সেবা গ্রহীতাদের আস্থাস্থল হয়ে উঠেছে। সেখানে সেবা গ্রহীতারা কোনোরকম ঝক্কি ঝামেলা ছাড়া নিজেরাই বিভিন্ন শাখায় হাজির থেকে প্রয়োজনীয় কাজ করছেন এবং স্বাচ্ছন্দ্যে হাসিমুখে ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে ঘুষ, হয়রানি, দালালি দৌরাত্ম্যের কোনো অভিযোগ সত্য নয় বলেও দাবি করেছেন মাসুদ আলম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর