সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

তিন লাখ চলন্ত সিলিন্ডার বোমা

মুহূর্তেই ঘটতে পারে ভয়াবহ সর্বনাশ

সাইদুর রহমান রিমন

তিন লাখ চলন্ত সিলিন্ডার বোমা

দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি সিলিন্ডারযুক্ত যানবাহনগুলো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। রিটেস্টিংবিহীন চরম ঝুঁকিপূর্ণ তিন লক্ষাধিক ‘সিলিন্ডার বোমা’ বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকারে সংযুক্ত অবস্থায় ঘুরে ফিরছে সর্বত্র। যে কোনো মুহূর্তে এ সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ডেকে আনতে পারে জানমাল ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ সর্বনাশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ভয়াবহ তাজা বোমার ন্যায় ক্ষতিসাধন করে। গাড়ির ফিটনেসের সঙ্গে রিটেস্ট বাধ্যতামূলক করা সত্ত্বেও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতায় বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সিএনজিচালিত এসব যানবাহনের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহূত সিলিন্ডার প্রতি ৫ বছর পরপর রিটেস্ট (পুনঃপরীক্ষা) করার বিধান রয়েছে। সব ধরনের সিলিন্ডারের রিটেস্টের অনুমোদন দেয় বিস্ফোরক অধিদফতর। এ ছাড়া যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। অন্যদিকে সিএনজি কনভার্সনসহ সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলে সরকারের আরপিজিসিএল। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও আইনে বাধ্যবাধকতা না থাকায় সিলিন্ডারের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই চলছে।

জ্বালানি বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৮০ সিএনজি কনভার্সন ওয়ার্কশপ রয়েছে। দেশে ১৫ বছর ধরে সিএনজিচালিত গাড়ির প্রচলন শুরু হয়েছে। সরকারের কাছে থাকা হিসেবে বলা হচ্ছে, দেশে দুই লাখ ৫৪ হাজার ৫২২ গাড়ি এখন পর্যন্ত জ্বালানি তেল থেকে সিএনজিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এসব গাড়িতে সিলিন্ডার রয়েছে চার লাখ। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, সিএনজি কনভার্সন সেন্টারসমূহে বড়জোর ৬৫ হাজার সিলিন্ডার রিটেস্ট করা হয়েছে। আগের দুই বছর যোগ করলে পাঁচ বছর মেয়াদোত্তীর্ণ ৯৪ হাজার সিলিন্ডার রিটেস্ট করা হলেও বাকি তিন লক্ষাধিক সিলিন্ডার আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও রিটেস্ট করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য সংযুক্ত সিএনজি সিলিন্ডার টানা ১৫ বছর ধরে ব্যবহারেরও ভয়ানক তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ফিটনেস থাকাবস্থায় সিএনজি সিলিন্ডারসমূহে প্রতি বর্গইঞ্চিতে তিন হাজার পাউন্ড চাপের গ্যাস গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ ও দেশীয় পদ্ধতিতে জোড়াতালি দিয়ে প্রস্তুতকৃত সিলিন্ডারে এ মাত্রার গ্যাস চাপ কোনোভাবেই ধারণ করতে পারে না। ফলে চলমান বোমা হয়ে ওঠা একেকটি গ্যাস সিলিন্ডার রীতিমতো বিস্ফোরোন্মুখ অবস্থায় থাকে। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি, ছোটখাটো দুর্ঘটনা বা ধাক্কাতেও সিলিন্ডারটি ভীষণ শক্তিতে বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি টাঙ্গাইল, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত অন্তত ১১টি সাধারণ দুর্ঘটনায় গোটা যানবাহন পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্য গাড়ির সামান্য ধাক্কায় রাস্তার উপরই কাত হয়ে পড়া যানবাহনটির গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে নির্গত গ্যাসে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। সেক্ষেত্রে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে আরও ভয়াবহ।

পৃথক তথ্যসূত্রে জানা যায়, গত প্রায় তিন বছরে দেশে সিএনজিচালিত ১৭৫টি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে এবং এতে প্রায় ৪০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। চলতি বছর শুরুর দিকে আশুলিয়ার ডেল্টা সিএনজি ফিলিং স্টেশনে একটি প্রাইভেটকারে সিএনজি গ্যাস নেওয়ার সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে গাড়ির মালিকসহ দুজন নিহত হন। সিলিন্ডারের ভগ্নাংশ দেখে পুলিশ ওই সময় নিশ্চিত হয় এতে জোড়াতালি ছিল। সূত্রমতে প্রতিটি গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের জন্য দু-তিন দিন সময় লাগে। এ ছাড়া রিটেস্টিং করাতে গেলে ২০ থেকে ৪০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য দুই হাজার টাকা, ৪০-৬০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য আড়াই হাজার টাকা, ৬০-৮০ লিটারের প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য তিন হাজার টাকা এবং ৮০ লিটারের বেশি প্রতিটি সিলিন্ডারের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। এ কারণে গাড়ির মালিকরা এ প্রক্রিয়াকে বাড়তি খরচ ও সময় নষ্ট বলে মনে করেন। বিস্ফোরক অধিদফতর সূত্র জানায়, মাঝে মধ্যে কিছু প্রাইভেটকারের পুনঃপরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যায়। তবে বাস-ট্রাক বা অন্য যানবাহনগুলোর কোনো তথ্যই তাদের কাছে নেই। দেশে এখন পর্যন্ত গত তিন বছরে ১৫০টির বেশি সিএনজিচালিত যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও কয়েকটি গাড়িতে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ খবর