সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বে-টার্মিনাল নির্মাণে ৫ দেশের লড়াই

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বে-টার্মিনাল নির্মাণে ৫ দেশের লড়াই

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও তার অপারেশনাল কাজ পেতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে চীন, ভারতসহ প্রভাবশালী পাঁচ দেশের মধ্যে। আগ্রহী অন্য তিন দেশ হচ্ছে সিঙ্গাপুর, কোরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। পাঁচ দেশের মধ্যে ভারত ছাড়া অন্য চার দেশ টার্মিনাল নির্মাণে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি নির্মাণে ঋণ দেওয়ার একটি প্রস্তাব রয়েছে ভারতের। এখন এসব প্রস্তাবনা বিবেচনায় কোন দেশকে কাজটি দেওয়া হবে সে বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা জানতে চেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।

জানা গেছে, এরই মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণের সমীক্ষা শেষ হয়েছে। একটি মাস্টারপ্ল্যানও পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী প্রকল্পটিতে মোট তিনটি টার্মিনাল হবে। একটি ১ হাজার ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, আরেকটি ১ হাজার ২২৫ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল ও অন্যটি ৮৩০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার টার্মিনাল-২। প্রস্তাবিত প্রকল্প নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) এবং জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার জন্য প্রশাসনিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চবক চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ পিএসসি, বিএন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বে-টার্মিনাল নির্মাণে আমরা কয়েকটি দেশের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছি। এখন সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বে-টার্মিনাল হলে আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরে বাংলাদেশে নতুন বন্দরের প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া বে-টার্মিনাল অতি অল্প সময়ের মধ্যে নির্মাণ করা সম্ভব। এ জন্য যে বিনিয়োগ হবে তার রিটার্নও আসবে দ্রুত। যে কারণে এই প্রকল্পে বিনিয়োগে সবার আগ্রহ বেশি। অন্যদিকে এই প্রকল্পের আয়তন চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় সমান হলেও উৎপাদনশীলতা হবে অনেক বেশি। সহজে বড় জাহাজ বে-টার্মিনালে আসতে পারবে। ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল করতে পারবে। বে-টার্মিনাল প্রতিষ্ঠা হলে স্বল্প সময়ে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে সড়ক, নৌ ও রেলপথে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য পৌঁছাতে পারবে। সূত্রগুলো জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্প নির্মাণে এখনো পর্যন্ত চারটি দেশের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। গত বছরের মে মাসে চীনের চায়না মার্চেন্টস স্পোর্ট হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড জিটুজি পদ্ধতিতে বে-টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি দেয়। পরে তারা বিওটি (বিল্ট অওন ট্রান্সফার) পদ্ধতিতেও প্রকল্প নির্মাণ এবং ৫০ বছরের কনসেশন চুক্তি সম্পন্ন করার আগ্রহ প্রকাশ করে। তাদের প্রস্তাবনায় প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ধরা হয়েছে ৩-৪ বছর। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। চায়নিজ কোম্পানিটি টার্মিনাল-১, ২ এবং মাল্টিপারপাস সুবিধা নির্মাণে সম্মত থাকলেও ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের কাজ চবককে করতে হবে।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি পিএসএ টার্মিনাল নির্মাণের চেয়ে টার্মিনাল অপারেশনে আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশি। পিএসএ জানিয়েছে, চবক যদি জমির মালিক হয় তবে তারা দীর্ঘমেয়াদে টার্মিনাল অপারেশনের চুক্তিতে যেতে আগ্রহী। আর চবক যদি জমির মালিক ও টার্মিনাল অপারেটর হয় তবে তারা জয়েন্টভেঞ্চারে অপারেশনের কাজটি করতে আগ্রহী। প্রকল্পের অন্যান্য কাজ ব্রেক ওয়াটার, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে তারা আগ্রহী নয়।

কোরিয়ান সরকারের মিনিস্ট্রি অব ফিশারিজ ও ওশানোগ্রাফির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন পূর্ণাঙ্গ টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক কাজ করার বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে তারা একটি প্রি ফিজিবিলিটি স্টাডিও করেছে। কোরিয়া বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি কনসেশন কন্ডিশন লোন পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এক্ষেত্রে কোরীয় সরকার ১৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ বার্ষিক শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ সুদে প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দেবে। ৪০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডও প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের প্রস্তাবে তারা প্রকল্পটি বিওটি অর্থাৎ বিল্ট অওন ট্রান্সফার পদ্ধতিতে নির্মাণ করতে ইচ্ছুক বলে জানিয়েছে। অথবা সরকার চাইলে তারা বে-টার্মিনাল অপারেট করতেও আগ্রহী বলে প্রস্তাবে জানিয়েছে ডিপি ওয়ার্ল্ড। এই চার দেশ ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ চুক্তি হয়েছে, সেই ঋণ চুক্তি থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার প্রস্তাবিত বে-টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগের বিষয়ে একটি দফা রয়েছে। তবে ভারতের প্রস্তাবিত ঋণ দিয়ে বে-টার্মিনালের কোনো অংশ নির্মাণ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর গতবছর ২৫ দশমিক ৬৬ লাখ টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভেলেন্ট) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। প্রতি বছর দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন বাড়ছে। চবক-এর মাস্টারপ্ল্যানে ২০২০ সালে বার্ষিক ২৯ লাখ এবং ২০৩৬ সালে ৫৬ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা অর্জন করার কথা রয়েছে বন্দরের। গতবছর বন্দরের মাধ্যমে ৬৩২ লাখ মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়েছে যা ২০৪৩ সালে ১২৪০ লাখে উন্নীত হবে বলে আশা করছে চবক। তবে বর্তমানে বন্দরের যে অবকাঠামো আছে তা দিয়ে উল্লিখিত পরিমাণ কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে করা সম্ভব হবে না। এ লক্ষ্যে বন্দরে কৌশলগত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ধারণক্ষমতা এবং কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং বাড়ানোর জন্য বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর