শিরোনাম
শনিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফাঁদে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা

দুই মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিউইয়র্কে আয়েশি জীবনযাপন করছেন প্রতারকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফাঁদে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা

নিউইয়র্ক প্রবাসী কয়েকজন  বাংলাদেশির প্রতারণায় রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অন্তত ১৫টি গার্মেন্টের মালিক পথে বসেছেন। চাকরি হারিয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। প্রতারকরা এসব গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কমপক্ষে দুই মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে নিউইয়র্কে আয়েশি জীবনযাপন করছেন। এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারক চক্র প্রতি বছর বাংলাদেশের অন্তত একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি টার্গেট করত। এ প্রক্রিয়ায় নিউইয়র্ক পোর্ট থেকে মাল খালাসের পর লাপাত্তা দিত তারা।  এমন প্রতারণা ও ধাপ্পাবাজি করে গত ১০ বছরে তারা কমপক্ষে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ  কয়েকটি অঞ্চলের ১৫টি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিককে পথে বসিয়েছে। বেতন-ভাতা দিতে না পেরে এর মধ্যে বেশকটিতে তালা ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। বেতন না পেয়ে হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রতারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিউইয়র্ক প্রবাসী মো. নূর ইসলাম (গাজী নুরু) এবং বাংলাদেশের দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট এবং বাংলাদেশের কয়েকটি থানায় মামলা হয়েছে। টার্গেট করে গার্মেন্ট আমদানির পর মূল্য পরিশোধ না করার পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর পরিশ্রমী গার্মেন্ট শ্রমিকরা নিদারুণ কষ্টে নিপতিত হওয়ার সংবাদে আমেরিকান শ্রমিক সংগঠনের আইনজীবীরাও গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী প্রবাসীদের এমন ঠকবাজির ফাঁদ ও মর্যাদা নিয়ে কর্মরত ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি’র প্রধান নির্বাহী কল্পনা আকতারের সঙ্গে এ নিয়ে টেলিফোনে কথা হলে তিনি জানান, ‘এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’ ভিকটিম ফ্যাক্টরির কয়েকটির নাম উচ্চারণ করলে কল্পনা আকতার বললেন, ‘নাম শুনে মনে হচ্ছে এগুলো পরিচিত কোনো ফ্যাক্টরি নয়।’ অথচ অনুসন্ধানে জানা গেছে, কল্পনা আকতার মাঝে-মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে এসে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার-বঞ্চিত হওয়ার কাহিনী গণমাধ্যমসহ মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে উপস্থাপন করেন। শ্রমিকদের নাজুক অবস্থার জন্য সরকারকেও দায়ী করেন এ নেত্রী।  অথচ হাজার শ্রমিকের মজুরি অনিশ্চিতের জন্য দায়ীদের ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না’-এ মন্তব্য করেন নিউদকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না বলে শ্রমিক-সংগঠকরা মন্তব্য করেছেন।

অভিযোগে প্রকাশ, নিউইয়র্কের উপরোক্ত গাজী নুরুর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে ২০১৫ সালের ২৯ মে ঢাকার বিশ্বাস ফ্যাশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৭৫০ ডলার ক্ষতিপূরণ দাবিতে মামলা হয়েছে। ইনডেক্স নম্বর-৬৯৭৫। এই মামলার নোটিস পাবার পর একই বছরের ৩০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের মেডিটেরিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি, ইউএসএ) জবাব দিয়েছে যে, এটি তাদের বিরুদ্ধে করা উচিত হয়নি। কারণ, এটি তাদের জানা নেই। এমএসসি হয়তো এজন্য দায়ী। উল্লেখ্য, একই মামলার মূল অভিযুক্ত মোহাম্মদ নূর ইসলাম তথা গাজী নূর নোটিসের কোনো জবাব দেননি এখন পর্যন্ত। মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে আরো রয়েছে ইউনাইটেড গ্লোবাল লজিস্টিক ইনক, মারকেন্টাইল ক্রেডিট ইনক। সেই মামলা এখনও বিচারাধীন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ থেকে  ট্যুরিস্ট কিংবা ভিজিট অথবা ইমিগ্র্যান্ট ভিসায় সদ্য আগতদের টার্গেট করেন নিউইয়র্কের চিহ্নিত একটি চক্র। সেই ব্যক্তিকে নগদ কমিশনের টোপ দিয়ে বাংলাদেশের যে কোনো একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাছে এলসি পাঠানো হয় লোভনীয় দামে টি শার্ট এবং অন্য পোশাকের বিপরীতে। অভিযুক্তরা শুধু কাগজপত্র (?) তৈরি করেন। সব যোগাযোগের বাহন করা হয় নবাগত ওই ব্যক্তিকে। এভাবে মালভর্তি কন্টেইনার নিউইয়র্কে  আসার পর প্রেরণকারী চট্টগ্রামের সিএনএফ-এর লোকজনের যোগসাজশে ভুয়া বিএল সংগ্রহ করা হয়। নিউইয়র্ক পোর্ট থেকে মাল খালাস করে নেওয়া হয়। ম্যানহাটানের কথিত শো রুমে উঠিয়ে তা বিক্রি করার পরও বাংলাদেশের সেই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক জানতে পারেন না প্রকৃত তথ্য। অধিকন্তু নিউইয়র্ক থেকে জানানো হয় যে, মাল আসতে বিলম্ব হয়েছে, যে স্যাম্পল দেখানো হয়েছিল, সে অনুযায়ী মাল পাঠানো হয়নি বলে ক্রেতারা নিতে চাচ্ছেন না। এজন্য পোর্টেই পড়ে রয়েছে কন্টেইনার। অর্থাৎ পোর্ট থেকে কন্টেইনার খালাস না করলে দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া গুনতে হবে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ী কোনো কুল-কিনারা না দেখে প্রস্তাব দেন যে, লোকসান দিয়ে হলেও যেন কন্টেইনার খালাস করা হয়। এমন দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া হয় পুরোদমে। সে সময়ে এক লাখ ডলারের কাপড়ের দাম ৪০ হাজারে নেমে আসে এবং বিক্রির পর সেই অর্থ পরিশোধের অঙ্গীকার করা হয়(প্রকৃত অর্থে ওই কাপড় আগেই বিক্রি হয়ে গেছে সিএনএফ’র সহায়তায় জাল বিএল’র মাধ্যমে)। এমন কথাতেও হাফ ছেড়ে বাঁচেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়, মাসের পর বছর অতিবাহিত হলেও ওই ৪০ হাজার ডলারও পরিশোধ করা হয় না। এ নিয়ে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিও এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। কারণ, বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি মালিকের সঙ্গে প্রতারকরা কখনোই তেমনভাবে যোগাযোগ করে না। পরিস্থিতির শিকার ব্যক্তিরা দেনদরবার করেও কূল-কিনারা পান না। বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি মালিকেরাও এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে নিকটস্থ থানা-পুলিশ করেন। অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের নিউ রেসুলি গার্মেন্টস, বিশ্বাস ফ্যাশন লিমিটেড, হালিমা গার্মেন্টস, সাফারি গার্মেন্টস, এইচ এ্যান্ড ডব্লিউ এপারেলসহ ১৫টি ফ্যাক্টরি বিভিন্ন থানায় নিউইয়র্কের এই চক্রের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন। গাজী নূরের ভাই দেলোয়ারকে কয়েক দফা থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। সম্প্রতি এই দেলোয়ার নিউইয়র্কে এসেছিলেন। কিন্তু পাওনাদারদের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতার চেষ্টা করেননি। এ ব্যাপারে ঢাকাস্থ ‘এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম টেলিফোনে এ সংবাদদাতাকে জানান, ডজনখানে ফ্যাক্টরি নিউইয়র্কের গাজী নূরের প্রতারণার শিকার হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও চেষ্টা করেছি ওই অর্থ উদ্ধারের জন্য। নিউইয়র্কে বৈঠকের চেষ্টাও করেছি।  কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পাইনি এখন পর্যন্ত। আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকালে নিজ দেশের ব্যবসায়ী ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের পেটে লাথি দেওয়ার এমন কাণ্ড প্রতিরোধে সব প্রবাসীর সহায়তা চাই।’ জানা গেছে, কয়েকজন ব্যবসায়ী ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে প্রতারকদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনও করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাড়া পাননি বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। অবশেষে তারা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার মার্কিন মানবাধিকার সংস্থার আইনজীবীগণের শরণাপন্ন হয়েছেন। ‘সিটিজেনশিপ গ্রহণকারী ওই ব্যক্তিরা কোনোভাবেই আইনের উর্দ্ধে নন, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পেলে সংশ্লিষ্টদের বিচারে সোপর্দ করা হবে’-মন্তব্য শ্রমিক নেতাদের। অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য জানতে কয়েক দফা ফোন করা হয় গাজী নূরকে। মেসেজও রাখা হয়েছে সেলফোনে। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি কলব্যাক করেননি।

সর্বশেষ খবর