গণপূর্ত বিভাগের বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু জাফর গত মার্চে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি চিঠি পান। তাতে দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনুসন্ধান করার জন্য সম্পদের বিবরণী চেয়ে দুদক একটি ‘অফিস আদেশ’ জারি করেছে। কর্মকর্তা এমন চিঠি দেখে নড়েচড়ে বসেন। চিঠিতে দুদকের লোগো ছাপানো। এই নোটিসের কপি যখন পড়ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলছিলেন, ‘হ্যালো আমি দুদক উপ-পরিচালক জহিরুল আলম বলছি। আপনার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনুসন্ধান করা হবে। আপনার বিরুদ্ধে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।’ কর্মকর্তাটি তখন ভালো করে দেখেন আদেশ কপিটি। দুদক উপ-পরিচালক জহিরুল আলমের স্বাক্ষর রয়েছে তাতে। ফোন রেখে তিনি দুদকে যোগাযোগ করলেন। উপ-পরিচালক জহিরুল আলমের খোঁজ করেন। কিন্তু তিনি যা জানলেন, তাতে করে তিনি আরও অবাক হলেন। ওই নামে দুদকে কোনো কর্মকর্তা নেই। তিনি নিশ্চিত যে প্রতারক চক্রের কাজ এটি। ধাপ্পাবাজি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। প্রায় একই প্রক্রিয়ায় গণপূর্ত অধিদফতরের পেকু সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী ফিরোজ হাসানকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে দুদক অভিযোগ করে, প্রকৌশলী হাসান জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অনেক সম্পদ অর্জন করেছেন। তাই তাকে দুদকের কাছে হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হবে। নিচে সই করেছেন দুদকের উপ-পরিচালক আবুল হোসেন। কিন্তু এই নামে দুদকে কোনো উপ-পরিচালক নেই। টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্প ও হাসপাতাল ২৫০ হতে ৫০০ শয্যায় উন্নতীকরণ প্রকল্পের পরিচালক প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আলী খানকে ১৯ মার্চ পাঠানো চিঠিতে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়। অব্যাহতির আদেশে স্বাক্ষরকারী হিসেবে দুদক সচিব শামসুল আরেফিনের নাম ব্যবহার করেছে প্রতারক চক্র। অথচ প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আলী খানের বিরুদ্ধে দুদক কোনো অনুসন্ধানই চালায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নামে ভুয়া নোটিস, আদেশ ও অভিযোগ থেকে অব্যাহিত দিয়ে সক্রিয় প্রতারক চক্র। দুদকের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রতারক চক্রটি সরকারি বিভিন্ন অফিসে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে নোটিস, অনুসন্ধান, আবার অর্থের বিনিময়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রলোভনও দেখায় চক্রটি। এ যেন দুদকের বাইরে আর একটি কমিশন। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে প্রতারক চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এই চক্রটি শনাক্ত করতে একটি বিশেষ টিম গঠন করেছে দুদক। একই সঙ্গে জরুরি সভা করে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। এ ছাড়াও প্রতারক চক্রের অনুসন্ধান পেলে ০১৭১১৬৪৪৬৭৫ নম্বরে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ সম্পদসহ নানা দুর্নীতির ভুয়া নোটিস ও আদেশের বেশকিছু অভিযোগ কমিশনের নজরে আসে। দুদক সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার অভিযান শক্তিশালী হওয়ার পর থেকে দুদকের ওই প্রতারক চক্র দুদকের বিভিন্ন কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অনেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়াও কেউ কেউ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে করে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতারক চক্রটি সক্রিয়। গত বছর এই চক্রটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। চলতি বছরে গ্রেফতার অভিযান চলাকালে বিষয়টি দুদকের নজরে আসে। এতে দেখা যায়, কখনো দুদকের উপ-পরিচালক, মহাপরিচালক কিংবা কখনো সচিব পরিচয় দিয়ে সরকারি বড় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করছেন, আবার অর্থের বিনিময়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিচ্ছেন। এভাবেই হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। প্রতারকরা কাল্পনিক অভিযোগ বা কমিশনের বিবেচনাধীন অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদানের আশ্বাস দিয়ে ও নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও বেসরকারি ব্যক্তিদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যদিও মাঝেমধ্যে এমন অনেক ভুয়া কর্মকর্তা দুদকের জালে ধরা পড়ছে। এ অবস্থায় এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে বলেছে দুদক। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এই সংস্থায় কোনো ব্যক্তির একক অভিপ্রায় অনুসারে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অথবা অভিযুক্ত হওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই। কমিশন অনুসন্ধান বা তদন্ত সংক্রান্ত সব ধরনের যোগাযোগ টেলিফোন বা মোবাইল ফোনে নিষিদ্ধ করেছে। কমিশনের এ সংক্রান্ত সব যোগাযোগ কেবল লিখিত পত্রের মাধ্যমেই করা হয়। টেলিফোন বা মোবাইল ফোনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো প্রশাসনিক এবং আইনি সুযোগ নেই। কমিশন এরূপ প্রতারকদের অবৈধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানাচ্ছে। এ জাতীয় প্রতারকদের আইনের আওতায় আনার জন্য এদের বিরুদ্ধে নিকটস্থ থানা অথবা র্যাব কার্যালয় অথবা দুদকের পরিচালক (মনিটরিং) টেলিফোন-৯৩৫২৫৫২ এবং মোবাইল নম্বর-০১৭১১৬৪৪৬৭৫-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।