রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাঙন থামছেই না পদ্মায়

প্রতিদিন ডেস্ক

ভাঙন থামছেই না পদ্মায়

পদ্মার ভাঙন থামেনি। বিশেষ করে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় নতুন করে গতকালও বিভিন্ন গ্রাম নদীগ্রাসে চলে গেছে। ঘরহীন হয়েছে ৯০টি পরিবার। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ—

শরীয়তপুর : নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন অব্যাহত আছে। গতকাল শুভগ্রাম, বাঁশতলা, পূর্ব নড়িয়া, উত্তর কেদারপুর, কেদারপুর দাসপাড়া ও পাঁচগাঁও গ্রামে তীব্র ভাঙন ছিল। ভাঙনে ওই গ্রামগুলোর ৯০টি পরিবার ঘরহীন হয়ে পড়েছে। আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়েছে ১০ হাজার পরিবার। গত তিন মাসে ভাঙনে ঘরহীন হয়েছে ৬ হাজার ১০০ পরিবার। এর মধ্যে সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য ৫ হাজার ৮০ পরিবারের তালিকা করেছে উপজেলা প্রশাসন। এদিকে কেদারপুর দাসপাড়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়াবহ ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেতে গতকাল গঙ্গাপূজার আয়োজন করে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ওই পূজায় এলাকার কয়েক শ নারী-পুরুষ অংশ নেয়। এ ছাড়া মুলফত্গঞ্জ মাদ্রাসাসহ আশপাশের ২০টি মসজিদে জুমার নামাজের পর বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়। জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিন  বলেন, ‘এরই মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। আরও দেড় হাজার পরিবারকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’ তিনি জানান, ভাঙনে ঘরহীন পরিবারের সংখ্যা ৬ হাজারের ওপরে পৌঁছেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকায় আরও পরিবার ঘরহীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল উত্তর কেদারপুর, কেদারপুর দাসপাড়া ও বাঁশতলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, আতঙ্কে মানুষ বসতঘর, জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে। সকাল থেকে বৃষ্টি থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে। অনেকে পাকা ঘর ফেলে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছিল। উত্তর কেদারপুর গ্রামের লুত্ফা বেগম (৬০) বলেন, ‘পদ্মার ভাঙনে কান্না করতে করতে আর চোখে পানি আসে না। একটি বাড়ি করেছি তাও পদ্মায় গিলে খেয়েছে।’ ভাঙন আতঙ্কে তিনি এখন বাড়িঘর ফেলে আশ্রয় ও খাবারের সন্ধান করছেন। তিনি বলেন, ‘শুনছি সরকার লাখ লাখ টাকা দিয়েছে, এগুলো কোথায় যায়? আমরা তো পাচ্ছি না।’ উত্তর কেদারপুর গ্রামের আছিয়া খাতুন (৬৬)। ছেলে মান্নান কাজী ইতালি থাকেন। কাজের বুয়াকে নিয়ে এক তলা একটি ভবনে থাকতেন আছিয়া খাতুন। ভাঙন আতঙ্কে তিনি পাকা ভবনটি ফেলে পাশের চণ্ডীপুর গ্রামে বাবার বাড়ি আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে ১০০ মিটার দূরত্বে রয়েছে নদী। আতঙ্কে রাতে ঘুম হতো না। তাই বসতভিটা-ঘর ছেড়ে চলে এসেছি।’ পূর্ব কেদারপুর গ্রামের নাসিমা বেগম (৫৫) ও তার স্বামী আলী আকবার খান জানান, তাদের সুখের সংসার ছিল, পদ্মা দুবারের ভাঙনে জায়গাজমি সব কেড়ে নিয়েছে। এখন পথে বসেছেন খোলা আকাশের নিচে। তারা বলেন, ‘কোনোরকমে থাকতেছি। এক বেলা খাইলে আরেক বেলা খাইতে পারি না।  অর্ধাহারে-অনাহরে দিন কাটাতে হচ্ছে। এইসঙ্গে এনজিওর কিস্তির জ্বালা রয়েছে। না খেয়ে থাকলেও কিস্তির টাকা দিতে হয়। তারা কোনো কথা শোনে না। কী করব, কোথায় যাব এখন? আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, কিস্তি বন্ধ করানো হোক, আমাদের পুনর্বাসন করা হোক।’

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মায় প্রচণ্ড স্রোত। তাই জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, ‘পাঁচ দিন যাবৎ ভাঙনকবলিত এলাকায় আছি। এখানকার মানুষের সঙ্গে থেকে কাজ করছি।’

গাইবান্ধা : উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও বর্ষণে গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও করতোয়ার পানি কয়েক দিন ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল ঘাঘটের পানি ১৬ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের ৭ সেন্টিমিটার, তিস্তার ১০ সেন্টিমিটার ও করতোয়ার পানি ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়। তবে এগুলো এখনো বিপদসীমার নিচে রয়েছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, পানি বৃদ্ধি পেতে থাকলেও নদ-নদীগুলো বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার, ঘাঘট গাইবান্ধা শহররক্ষা বাঁধ পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার, তিস্তা সুন্দরগঞ্জের গোয়ালের ঘাট পয়েন্টে ১৩৪ সেন্টিমিটার ও করতোয়া গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী পয়েন্টে ১৯৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে মাঝারি ধরনের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে পানি বৃদ্ধিতে তিস্তা, ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রের চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবু হানিফ প্রামাণিক গতকাল জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধিতে তার ইউনিয়নে চৌমোহন, বুলবুলির চর, পূর্ব খাটিয়ামাড়ি, মধ্য খাটিয়ামাড়ি, উজানডাঙ্গাসহ ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে দেড় শতাধিক পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে। নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে উজানডাঙ্গা গ্রামের অন্তত ৫০টি পরিবার। তাদের জমি, বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উজানডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কমিউনিটি ক্লিনিক ভাঙনের মুখে। এ ছাড়া তিস্তার পানি বৃদ্ধিতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চণ্ডীপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন জানান, পানি বেড়ে যাওয়ায় তার ইউনিয়নে শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নুরুন্নবী সরকার জানান, ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে পানিবন্দী পরিবারদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

বগুড়া : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় যমুনাপাড়ের মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ধুনট উপজেলার ভাণ্ডারবাড়ী ইউনিয়নে যমুনার পানি ১৬ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার বিপদসীমা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কয়েক দিন ধরে পানি বাড়ছে। গত ১২ ঘণ্টায় ৬ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত যমুনার পানি বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে যমুনাপাড়ের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরই মধ্যে নদীর কূল উপচে পানি চরাঞ্চল ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দিকে ধেয়ে আসা শুরু করেছে। নদীর পূর্বতীর ডুবে পুকুরিয়া, নিউ সারিয়াকান্দি, বৈশাখী ও রাধানগর চরের কৃষকের জমির ধান, মাষকলাই, মরিচ ও বিভিন্ন জাতের সবজি খেতে পানি প্রবেশ করছে। বগুড়া পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ বলেন, যমুনায় পানি বাড়ছে। এ কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর